ইট পাটকেল পর্ব ১৩ - ইট পাটকেল সকল পর্বের লিংক
রাতের আকাশ দেখায় মগ্ন নূর। আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে কিছু একটা ভেবে চলেছে সে।আশমিন এখনো বাসায় আসে নি।তার জন্যই অপেক্ষা করছে নূর।মুখে স্বীকার না করলেও সে আশমিন কে অসম্ভব ভালবাসে। আশমিন তার রক্তে মিশে আছে। এক মুহুর্ত চোখের আড়াল হলেই ভুকের ভিতর আনচান শুরু হয়ে যায়।
আরো পড়ুন : ইট পাটকেল পর্ব ১
আচ্ছা, আশমিন কি বুঝতে পারে তার অস্থিরতা? তার চোখ দেখে ভালবাসার গভীরতা বুঝতে পারে এই বজ্জাত মন্ত্রী? আশমিনের ভালবাসায় আবার অত রাখ ঢাক নেই।সে যেখানে সেখানে নিজের ভালবাসা প্রকাশ করে ফেলে।গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলাকালীন বউয়ের কথা মনে পরলে মিটিং থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,
আরো পড়ুন : ইট পাটকেল পর্ব ১
ইট পাটকেল পর্ব ২
ইট পাটকেল পর্ব ৩
ইট পাটকেল পর্ব ৪
ইট পাটকেল পর্ব ৫
ইট পাটকেল পর্ব ৬
ইট পাটকেল পর্ব ৭
ইট পাটকেল পর্ব ৮
ইট পাটকেল পর্ব ৯
ইট পাটকেল পর্ব ১০
ইট পাটকেল পর্ব ১১
ইট পাটকেল পর্ব ১২
ইট পাটকেল পর্ব ১৩
ইট পাটকেল পর্ব ১৪
ইট পাটকেল পর্ব ১৫
ইট পাটকেল পর্ব ১৬
ইট পাটকেল পর্ব ১৭
ইট পাটকেল পর্ব ১৮
ইট পাটকেল পর্ব ১৯
ইট পাটকেল পর্ব ২০
ইট পাটকেল পর্ব ২১
ইট পাটকেল পর্ব ২২
ইট পাটকেল পর্ব ২৩
ইট পাটকেল শেষপর্ব ২৪
— কিছুক্ষন আলোচনা বন্ধ রাখুন। আমি আমার বউ কে মিস করছি।তার সাথে কথা বলা এই মুহুর্তে অক্সিজেন নেয়ার মতো জরুরি।
প্রথম প্রথম সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেও এখন এসব স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আড়ালে সবাই মুখ টিপে হাসলেও মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস কেউ করে না।
পিছন থেকে কেউ জরিয়ে ধরায় ধ্যান ভাঙ্গলো নূরের।আশমিনের জেন্টস পারফিউম নাকে ধাক্কা খেতেই মুখে হাসি ফুটলো নূরের।
— আমাকে রেখে আকাশে কি দেখো বউ?
নূর হালকা হেসে জরিয়ে ধরলো আশমিন কে।
— আকাশের মাঝে আমি আপনাকেই খুজি মন্ত্রী সাহেব। আপনি যখন আমার থেকে দূরে থাকেন,তখন আমার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে।মনে হয় এই আকাশের নিচেই তো আপনি আছেন।আমাদের মাঝে কোন দূরত্ব নেই। আপনি আর আমি এক আকাশের নিচেই আছি।
আশমিন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে। আজ নূরের চোখে শুধু তার জন্য ভালোবাসা ই দেখতে পাচ্ছে। আশমিন নূরের কপালে চুমু খেয়ে মন্থর গলায় বলল,
— ভালবাসি বউ।আমাদের মাঝে যাই কিছু হয়ে যাক না কেন, কখনো আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।সহ্য করতে পারবো না আমি।আমার জীবনে আমি নিজের বলতে শুধু তোমাকেই বুঝি।যে আমার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ। যাকে আমি আমার নিজের চেয়েও বেশি চাই।তুমি হচ্ছো আমার একমাত্র প্রশান্তির কারণ। আমার চক্ষুশীতল কারিনী।তুমি যদি চাঁদ হও তাহলে আমি সুবিশাল আকাশ নূর।তোমার আমাতে উঠে আমাতেই অস্ত যেতে হবে। পালানোর চেষ্টা করো না নূর।তোমার শুরু থেকে সমাপ্তি আমিতেই সীমাবদ্ধ।
নূর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন নিজেতে আবদ্ধ করে নিলো নূর কে।নাকে নাক ঘষে গালে হাত বুলিয়ে নূরের চোখে চোখ রাখলো।নূর আশমিনের চোখে চোখ রেখে বললো,
— আমার বিশ্বাস নিয়ে কখনো খেলবেন না মন্ত্রী সাহেব। আমি বিশ্বাসঘাতকদের কখনো ক্ষমা করি না। যে সম্পর্কে ধোকা,কপটতা, প্রতারণা থাকবে সে সম্পর্ক নূর পায়ে মারাতে এক মিনিট ও সময় নষ্ট করবে না।আপনি আমাকে বিশ্বাসের নিশ্চয়তা দিন।আমি আপনাকে সম্পর্কের নিশ্চয়তা দিবো।নূর নামের অর্থ জানেন তো মন্ত্রী সাহেব? নূর মানে হচ্ছে আলো।আলোকে বন্দি করার ক্ষমতা আল্লাহ বাদে কার আছে?আমি চাইলে আপনি আমার ছায়ার নাগাল ও পাবেন না। তাই সাবধান।যে নূর আপনাকে ভালবেসে জান্নাত দেখাতে পারে।সে নূর ঘৃণা করে আপনার জীবন জাহান্নাম ও করে দিতে পারে।
আশমিনের বুক কেপে উঠলো নূরের কথা শুনে। হাতের বাধন হালকা হয়ে গেলো। অস্থির চোখ জোড়া নূরের চোখে রাখতেই নূরের কথার সত্যতা দিনের মতো পরিস্কার দেখতে পেলো সে।নূর গভীর চোখে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। তার বুকেও কাপন ধরেছে।এই ভালবাসায় ফাটল ধরবে না তো?
ভালবাসার খুনশুটি তে নূর আর আশমিনের জীবন। কামিনী চৌধুরী হঠাৎ করেই চুপ করে গেছে।আশিয়ান ও নিজের মতোই আছে।এ যেন ঝড় আসার আগের নিস্তব্ধতা। আশমিন আর নূরের সম্পর্ক স্বাভাবিক দেখা গেলেও তাদের মনের খবর সম্পর্কে কেউ ই অবগত না।গত দেড় মাস যাবৎ অমি গুম হয়ে আছে।আমজাদ চৌধুরী নিজের মতো থাকে।সংসার টা মায়া বেগম টেনে হিচড়ে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সংসারের দিকে কারোর মন নেই। যে যার কাজে ব্যস্ত।আশমিন রাজনীতি নিয়ে ইদানীং খুব ব্যস্ত থাকে। যতটুকু সময় পায় নূরের সাথেই কাটায়।
হঠাৎ করেই নূরের অফিসে লারার আগমন। লারা কে দেখে বিরক্ত চোখে তাকালো নূর।আশমিনের এতো অপমানের পরেও এই মেয়ের লজ্জা হয় নি।
লুবানা লারার এভাবে হুট করে ঢুকে পরায় কপাল কুচকে তাকিয়ে আছে। চোখ ঘুড়িয়ে নূরের দিকে তাকাতেই বুঝলো এই আগুন্তকের আগমনে নূর খুশি নয়।
— এভাবে অসভ্যের মতো নক না করে ঢুকে পরলেন কেন?যান,আবার গিয়ে নক করে তারপর অনুমতি নিয়ে তারপর আসুন।
লুবানার কাটকাট গলায় বলা কথা গুলো শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো লারার।
— মুখে লাগাম দিয়ে কথা বলো।দু টাকার কর্মচারী হয়ে এভাবে কথা বলো কিভাবে?সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। বাইরে যাও।আমার নূরের সাথে কথা আছে।
— মুখে লাগাম দিবো কেন?আমি কি ঘোড়া নাকি?আমার লাগামের কথা চিন্তা না করে আপনি আপনার পায়ে লাগাম দিন।যেখানে সেখানে ঢুকে পরে।
লারা দাতে দাত চেপে তাকিয়ে রইলো লুবানার দিকে। নূর নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে। এখানে কি হচ্ছে তাতে তার কোন মাথা ব্যথা নেই।লারা নূরের এই নির্লিপ্ততা দেখে ফুসে উঠলো। দাত কিড়মিড় করে বললো,
— খুব দেমাগ বেড়েছে না?যে আশমিনের জন্য এতো আকাশে উড়ছো সেই তোমাকে ছুড়ে ফেলবে। ভোগ করা শেষ হলে রাস্তায় ছুড়ে মারবে।তখন না এ ঘাটের রবে না ও ঘাটের।
নূর শান্ত চোখে তাকালো লারার দিকে। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বললো,
— নূর কোন মন্ত্রীর দাপটে চলে না।আমি কে ভুলে গেছো বুঝি?তেহজিব নূর শিকদার আমি।শিকদারেরা মন্ত্রী বানায়। মন্ত্রীদের ক্ষমতায় চলে না। তোমার কি মনে হয় লারা?পুকুরের পানি দিয়ে শিকদাররা এই সাগর বানিয়েছে? নর্দমায় থাকো তো।তাই এই বিশাল সাম্রাজ্য সম্পর্কে ধারণা নেই।
লুবানা,,,একে নর্দমায় ফেলে দিয়ে এসো।ম্যাডামের এতো ভালো পরিবেশ সহ্য হয় না।
লারা সাপের মতো ফোসফাস করতে লাগলো। শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষা। তখন দেখবে এতো ভাব কোথায় থাকে।
— ও ম্যাডাম। দরজা ওই দিকে।নাকি সিকিউরিটি ডাকতে হবে।
লারা লুবানার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল অফিস থেকে।
নূর চোখ বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে। লুবানা কিছু না বুঝলেও তার নূরের জন্য খারাপ লাগলো।আশমিন কে তার খারাপ মনে হয় নি। তার সাথে খুবই ভালো ব্যবহার করে। বড় ভাইয়ের মতো স্নেহ করে।নূরের সমস্ত খবরাখবর তার থেকেই নেয়।মাথা ঘুরতে শুরু করেছে লুবানার।
— আপনি ঠিক আছেন ম্যাম?
— হুম।আজকের মিটিং গুলো ক্যান্সেল করে দাও।আমি বাসায় যাচ্ছি।
লুবানা মাথা নেড়ে সায় জানালো। আশমিন আজ সারাদিন নূরের খবর নেয়ার সুযোগ পায়নি।মন্ত্রণালয়ে আটকে গেছে। ইদানীং নূরের শরীর খুব একটা ভালো থাকে না।খাওয়া দাওয়ার প্রচন্ড অরুচি। আশমিন জোর করে ও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারেনি। তাই আজ ডাক্তার বাসায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।তার বউ খাবার দেখে নাক মুখ কুচকে ফেলবে আর সে মুখ বুজে দেখবে তা হতে পারে না। এক বিয়ে করেই তার এই অবস্থা! বাবার মতো দুই বউ থাকলে না জানি কি হতো!
নূর বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে সোজা স্টাডি রুমে চলে গেলো। মায়া বেগম নূরের খাবার টা স্টাডি রুমেই পাঠিয়ে দিলো। বাসায় এখন আর একসাথে বসে খাওয়া দাওয়া হয় না।একেক জন একেক সময় খায়।কামিনী চৌধুরী কানাডা গিয়েছে দুই দিন আগে।মায়া বেগমের সাথে সে খারাপ ব্যবহার করে না। কোন কথা ও বলে না।আমজাদ চৌধুরীর সামনেও খুব কম পরে। আমজাদ চৌধুরী চাতক পাখির মতো বসে থাকে তাকে এক পলক দেখার জন্য। কিন্তু দিনে একবার ও দেখা পান না। মাঝে মাঝে সপ্তাহ পার হয়ে যায়। অপেক্ষা শেষ হয় না।
আশমিন বাড়িতে যখন ঢুকেছে তখন রাত দশটা।আমজাদ চৌধুরী সোফায় চোখ বুজে বসে আছে। কয়েকদিনে বয়স অর্ধেক বেড়ে গেছে।আশমিন ধপ করে গিয়ে তার পাশে বসে পরলো। গম্ভীর গলায় বলল,
স্টাডি রুমে বিধ্বস্ত হয়ে বসে আছে নূর। অনুভূতিহীন চোখে এক মনে তাকিয়ে আছে আশমিনের ডায়েরির দিকে।একটি মাত্র ডায়েরি জীবনের অনেক অসমাপ্ত গল্পের সমাপ্তি টেনে দিয়েছে।দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোর খামচে ধরে বসে আছে নূর। কান্না আটকানোর জন্য ঠোঁট কামড়ে ধরায় ঠোঁট কেটে র*ক্ত বেরিয়ে গেছে।ডায়েরি থেকে নজর সরিয়ে রক্তাক্ত চোখে তাকালো দেয়ালে টাঙ্গানো আশমিনের বিশাল ফ্রেমের ছবির দিকে। নিজেকে টেনে হিচড়ে দাড় করালো নূর। ডায়েরি টা জায়গা মতো রেখে আশমিনের ছবির সামনে এসে দাড়ালো।
— ধোকা! এত বড় ধোকা! (ছবিতে হাত বুলিয়ে) আপনাকে কি শাস্তি দেই বলুন তো মন্ত্রী সাহেব? কি নিখুঁত অভিনয় আপনার! আপনি তো নিজের পারফরম্যান্স দেখিয়ে দিলেন।এবার আমার টা দেখানোর পালা। অভিনয় করতে ভালো লাগে তাই না? তো চলুন,এক দফা টক্কর আমাদের মাঝেও হয়ে যাক(দাতে দাত চেপে)। আপনার চালে যদি আপনাকে মাত না দিয়েছি তো আমার নাম ও তেহজিব নূর শিকদার নয়।
আশমিন আসার পর থেকে নূর কে একবার ও দেখে নি। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে কপাল কুচকে চারিদিকে চোখ বুলালো সে।হাতের তাওয়াল টা বারান্দায় দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মায়া রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। আশমিন নিচে এসে অস্থির গলায় বলল,
— নূর কোথায় আন্টি?
— বউমা তো অনেকক্ষণ আগে স্টাডি রুমে গিয়েছে। দুপুরের খাবার টাও ওখানেই খেয়েছে। নিচে তো আসতে দেখিনি।
আশমিন ভয়ার্ত চোখে তাকালো মায়া বেগমের দিকে। হুশ ফিরতেই এক প্রকার দৌড়ে গেল স্টাডি রুমের দিকে। মায়া বেগম প্রথমে অবাক হলেও পরে মুচকি হেসে নিজের কাজে মন দিলো। শুধু বাড়ির লোক ই না, চেনা জানা সবাই জানে আশমিন নূর কে চোখে হারায়।শাজাহানের মতো নূরের জন্য নূরমহল বানিয়ে ফেললেও কেউ অবাক হবে না।সেফ কে নিজের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে রুমের দিকে গেলেন মায়া বেগম। শরীর টা আজ খুব একটা ভালো না।জ্বর আসবে হয়তো। আমজাদ চৌধুরী তার দিকে ফিরেও তাকায় না।তাতে অবশ্য তার কষ্ট হয় না। বরং এমন নিখাত ভালবাসা দেখে মনে মনে তৃপ্তি পায় সে।
হুড়মুড় করে স্টাডি রুমে ঢুকতেই নূর আশমিনের দিকে চোখ তুলে তাকালো। নূরের হাতে সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন বইটি। আশমিন স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। নূর মুচকি হেসে বই রেখে উঠে দাড়ালো। ধীর পায়ে কাছে এসে আশমিনের বুকে মাথা এলিয়ে দিলো। আশমিন ও আগলে নিলো নূর কে।হৃদপিণ্ডের তীব্র ধুকপুকানি নূরের কানে এসে বারি খাচ্ছে। নূর বাকা হাসলো, ব্যাঙ্গাত্মক গলায় বলল,
— ভয় পেয়েছেন নাকি মন্ত্রী সাহেব? এভাবে বুক কাপছে কেন?এভাবে তো অপরাধীর বুক কাপে। করেছেন নাকি কোন বড়সড় অপরাধ?
আশমিন হাত আলগা করে নূর কে নিজের সামনে আনলো।নূরের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নূরের চোখ একেবারে শান্ত।হাসি হাসি মুখে সে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন নিজেকে শান্ত করলো। নূর কে নিজের সাথে চেপে ধরে আস্তে করে বললো,
— অপরাধ তো করেছি বউ।আজ সারাদিন বউয়ের খবর নিতে পারিনি।এটা তো গুরুতর অপরাধ। শাস্তি তো পেতেই হবে।
— হুম,আমি দিবো আপনাকে শাস্তি। আজ সারা রাত আমার সাথে বারান্দায় গল্প করে কাটাতে হবে। শাস্তি মঞ্জুর তো মন্ত্রী সাহেব?
আশমিন চোখে হাসলো। নূরের কপালে চুমু খেয়ে ঘোর লাগা গলায় বলল,
— এমন শাস্তি আমি সারাজীবন পেতে চাই বউ।
আশমিনের কাছে আসায় গা গুলিয়ে উঠলো নূরের। নিজেকে ছাড়িয়ে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাড়ালো। আশমিন ভ্রু কুচকে ফেললো। নূরের ঠোঁটের দিকে চোখ যেতেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো তার। দ্রুত পায়ে এসে নূরের গাল চেপে ধরলো।কাটা জায়গায় স্লাইড করতে করতে বললো,
— এভাবে কাটলো কিভাবে? ঠোঁট কামড়েছো কেন?এখন আমি চুমু খাবো কোথায়?
প্রথম কথা গুলো রাগ করে বললেও শেষ কথা টা দুঃখী দুঃখী গলায় বলল আশমিন। নূর শান্ত চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। অভিনয়েও বুঝি ভালবাসা এতো নিখুঁত হয়!
— এই মেয়ে,কথা বলছো না কেন?
আশমিনের ধমকের পিঠে কিছু বলার আগেই মাথা ঘুরে উঠলো নূরের। ঝাপসা চোখে একবার আশমিনের দিকে তাকিয়ে ঢলে পরতেই আশমিন আগলে নিলো নূর কে। অস্থির গলায় ডাকতে লাগলো,, — বউ!কি হয়েছে তোমার? নূররর,,,,
নূর কে কোলে তুলে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতেই চিৎকার করে সবাই কে ডাকলো আশমিন।বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে অস্থির হয়ে ফোন করলো ডক্টর কে।ততক্ষণে বাড়ির সবাই এসে পড়েছে।লুবানা গিয়ে নূরের হাত পা মালিশ করতে লাগলো। মায়া বেগম চোখে পানি ছিটিয়ে দিলেও নূরের জ্ঞান ফিরলো না।আশমিন পাগলের মতো নূর কে ডেকে যাচ্ছে বারবার। লুবানার ছোট ভাই লিমন এক কোনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সে আশমিন কে ভয় পায়।এখন আশমিনের পাগলামি দেখে আরো ভয়ে সিটিয়ে গিয়েছে।আমজাদ চৌধুরী চিন্তিত গলায় বলল,
— এভাবে বসে থেকো না। ওকে হসপিটাল নিয়ে যাও।
আশমিন আর এক মুহুর্ত দেড়ি করলো না।নূর কে কোলে তুলে রুম থেকে বেরুতেই সানভি হন্তদন্ত পায়ে প্রবেশ করলো ডক্টর নিয়ে।আশমিন আবার নূর কে রিমে নিয়ে শুয়িয়ে দিলো।সবাই কে বেরিয়ে যেতে বলতেই আশমিনের ভয়ংকর দৃষ্টিতে দমে গেল ডক্টর। সবাই বেরিয়ে গেল ও আশমিম নূরের হাত ধরে তার পাশেই বসে রইলো। ডক্টর চেকআপ করে মুচকি হেসে আশমিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
— অভিনন্দন স্যার।সি ইজ প্রেগন্যান্ট। অতিরিক্ত চিন্তার জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন।এখন ওনার রেস্ট প্রয়োজন। আমি ইঞ্জেকশন দিয়ে দিচ্ছি। কাল সকালের আগে ঘুম ভাঙ্গবেনা।কাল হসপিটালে গিয়ে কিছু টেস্ট করিয়ে আনবেন।তাহলে ম্যামের কন্ডিশন ভালো ভাবে বোঝা যাবে।
ডক্টরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আশমিন।তার কানে শুধু একটা কথাই বাজছে,”সি ইজ প্রেগন্যান্ট “ডাক্তারের বাকি কথা তার কানে গেলো কি না বোঝা গেলো না।ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিতেই ডাক্তার মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল। আশমিন একমনে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে। নূরের চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। আশমিনের হাতের মুঠোয় থাকা নূরের হাতটার কয়েকটা নখ ভেঙে গিয়েছে। আশমিন হালকা ঝুকে জরিয়ে ধরলো নূর কে।উত্তেজনায় তার পুরো শরীর কাপছে। মনে হচ্ছে সে জ্ঞান হারাবে।
নিচে লুবানার চিৎকার শোনা যাচ্ছে। সানভি ধমকেও তাকে থামাতে পারছেনা।
— এভাবে চিৎকার করছো কেন সাবানা?অসভ্যের মতো চিৎকার করা বন্ধ করো।ছিঃ, কি গলা।মনে হচ্ছে ফাটা বাসের ভিতর আটকে পরা ইদুর কিচমিচ করছে।
লুবানা সমস্ত আনন্দ ভুলে ফুসে উঠলো। কটমট করে তাকালো সানভির দিকে।
— ও হ্যালো,মি.কবরস্থানের বাসিন্দা। আমার নাম লুবানা।লু,,বা,,না।নট সাবানা। আর আমার গলা মোটেও ইদুরের মতো নয়।আপনার কানে সমস্যা।লক্কর ঝক্কর যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘুরে বেরাতে লজ্জা করে না আপনার?তাজ্জব ব্যাপার!
সানভি রাগী চোখে তাকিয়ে আছে লুবানার দিকে। মেয়ের সাহস দেখে অবাক হচ্ছে সে।আর এদিকে লিমন দুজনের ঝগড়া দেখছে আর হাই তুলছে।আমজাদ চৌধুরী আর মায়া বেগম নূরের রুমে গিয়েছে। না হলে ইজ্জত পানি পানি হয়ে যেতো এই মেয়ের জন্য।
— দেখো মেয়ে,, বেশি বারাবাড়ি করবে না। না হলে ছাদে তুলে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিবো।বেয়াদবির একটা আদব থাকা দরকার।
— হুহ,,আসছে ধাক্কা দিতে।বলি হাড়গোড় সব ঠিক যায়গায় আছে তো?আগে চেক করে আসুন।দেখা গেলো চোখ কানের মতো হাড্ডি ও দুই একটা কবরে রেখে এসেছেন।
লুবানা মুখ বাকিয়ে চলে গেলো। সানভি কটমট করতে করতে লিমন কে বললো,
— দেখেছো? দেখেছো কেমন বেয়াদব?
লিমন হচকচিয়ে গেলো। জোর পুর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,
— জ্বি ভাইয়া।ছোট বেলা থেকেই দেখছি।
আশমিনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আমজাদ চৌধুরী।ছলের খুশির পরিমাণ তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আশমিন আমজাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে দাম্ভিক হাসি দিলো।আমজাদ চৌধুরী ভ্রু কুচকে তাকালো ছেলের দিকে। নিশ্চিত এখন বেহায়া মার্কা কিছু বলবে।এখানে মায়া বেগম ও আছে।আমজাদ চৌধুরী আর লজ্জায় পরতে চাইলো না। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিতেই আশমিন তার কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
প্রথম প্রথম সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেও এখন এসব স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আড়ালে সবাই মুখ টিপে হাসলেও মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস কেউ করে না।
পিছন থেকে কেউ জরিয়ে ধরায় ধ্যান ভাঙ্গলো নূরের।আশমিনের জেন্টস পারফিউম নাকে ধাক্কা খেতেই মুখে হাসি ফুটলো নূরের।
— আমাকে রেখে আকাশে কি দেখো বউ?
নূর হালকা হেসে জরিয়ে ধরলো আশমিন কে।
— আকাশের মাঝে আমি আপনাকেই খুজি মন্ত্রী সাহেব। আপনি যখন আমার থেকে দূরে থাকেন,তখন আমার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে।মনে হয় এই আকাশের নিচেই তো আপনি আছেন।আমাদের মাঝে কোন দূরত্ব নেই। আপনি আর আমি এক আকাশের নিচেই আছি।
আশমিন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে। আজ নূরের চোখে শুধু তার জন্য ভালোবাসা ই দেখতে পাচ্ছে। আশমিন নূরের কপালে চুমু খেয়ে মন্থর গলায় বলল,
— ভালবাসি বউ।আমাদের মাঝে যাই কিছু হয়ে যাক না কেন, কখনো আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।সহ্য করতে পারবো না আমি।আমার জীবনে আমি নিজের বলতে শুধু তোমাকেই বুঝি।যে আমার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ। যাকে আমি আমার নিজের চেয়েও বেশি চাই।তুমি হচ্ছো আমার একমাত্র প্রশান্তির কারণ। আমার চক্ষুশীতল কারিনী।তুমি যদি চাঁদ হও তাহলে আমি সুবিশাল আকাশ নূর।তোমার আমাতে উঠে আমাতেই অস্ত যেতে হবে। পালানোর চেষ্টা করো না নূর।তোমার শুরু থেকে সমাপ্তি আমিতেই সীমাবদ্ধ।
নূর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন নিজেতে আবদ্ধ করে নিলো নূর কে।নাকে নাক ঘষে গালে হাত বুলিয়ে নূরের চোখে চোখ রাখলো।নূর আশমিনের চোখে চোখ রেখে বললো,
— আমার বিশ্বাস নিয়ে কখনো খেলবেন না মন্ত্রী সাহেব। আমি বিশ্বাসঘাতকদের কখনো ক্ষমা করি না। যে সম্পর্কে ধোকা,কপটতা, প্রতারণা থাকবে সে সম্পর্ক নূর পায়ে মারাতে এক মিনিট ও সময় নষ্ট করবে না।আপনি আমাকে বিশ্বাসের নিশ্চয়তা দিন।আমি আপনাকে সম্পর্কের নিশ্চয়তা দিবো।নূর নামের অর্থ জানেন তো মন্ত্রী সাহেব? নূর মানে হচ্ছে আলো।আলোকে বন্দি করার ক্ষমতা আল্লাহ বাদে কার আছে?আমি চাইলে আপনি আমার ছায়ার নাগাল ও পাবেন না। তাই সাবধান।যে নূর আপনাকে ভালবেসে জান্নাত দেখাতে পারে।সে নূর ঘৃণা করে আপনার জীবন জাহান্নাম ও করে দিতে পারে।
আশমিনের বুক কেপে উঠলো নূরের কথা শুনে। হাতের বাধন হালকা হয়ে গেলো। অস্থির চোখ জোড়া নূরের চোখে রাখতেই নূরের কথার সত্যতা দিনের মতো পরিস্কার দেখতে পেলো সে।নূর গভীর চোখে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। তার বুকেও কাপন ধরেছে।এই ভালবাসায় ফাটল ধরবে না তো?
ভালবাসার খুনশুটি তে নূর আর আশমিনের জীবন। কামিনী চৌধুরী হঠাৎ করেই চুপ করে গেছে।আশিয়ান ও নিজের মতোই আছে।এ যেন ঝড় আসার আগের নিস্তব্ধতা। আশমিন আর নূরের সম্পর্ক স্বাভাবিক দেখা গেলেও তাদের মনের খবর সম্পর্কে কেউ ই অবগত না।গত দেড় মাস যাবৎ অমি গুম হয়ে আছে।আমজাদ চৌধুরী নিজের মতো থাকে।সংসার টা মায়া বেগম টেনে হিচড়ে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সংসারের দিকে কারোর মন নেই। যে যার কাজে ব্যস্ত।আশমিন রাজনীতি নিয়ে ইদানীং খুব ব্যস্ত থাকে। যতটুকু সময় পায় নূরের সাথেই কাটায়।
হঠাৎ করেই নূরের অফিসে লারার আগমন। লারা কে দেখে বিরক্ত চোখে তাকালো নূর।আশমিনের এতো অপমানের পরেও এই মেয়ের লজ্জা হয় নি।
লুবানা লারার এভাবে হুট করে ঢুকে পরায় কপাল কুচকে তাকিয়ে আছে। চোখ ঘুড়িয়ে নূরের দিকে তাকাতেই বুঝলো এই আগুন্তকের আগমনে নূর খুশি নয়।
— এভাবে অসভ্যের মতো নক না করে ঢুকে পরলেন কেন?যান,আবার গিয়ে নক করে তারপর অনুমতি নিয়ে তারপর আসুন।
লুবানার কাটকাট গলায় বলা কথা গুলো শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো লারার।
— মুখে লাগাম দিয়ে কথা বলো।দু টাকার কর্মচারী হয়ে এভাবে কথা বলো কিভাবে?সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। বাইরে যাও।আমার নূরের সাথে কথা আছে।
— মুখে লাগাম দিবো কেন?আমি কি ঘোড়া নাকি?আমার লাগামের কথা চিন্তা না করে আপনি আপনার পায়ে লাগাম দিন।যেখানে সেখানে ঢুকে পরে।
লারা দাতে দাত চেপে তাকিয়ে রইলো লুবানার দিকে। নূর নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে। এখানে কি হচ্ছে তাতে তার কোন মাথা ব্যথা নেই।লারা নূরের এই নির্লিপ্ততা দেখে ফুসে উঠলো। দাত কিড়মিড় করে বললো,
— খুব দেমাগ বেড়েছে না?যে আশমিনের জন্য এতো আকাশে উড়ছো সেই তোমাকে ছুড়ে ফেলবে। ভোগ করা শেষ হলে রাস্তায় ছুড়ে মারবে।তখন না এ ঘাটের রবে না ও ঘাটের।
নূর শান্ত চোখে তাকালো লারার দিকে। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বললো,
— নূর কোন মন্ত্রীর দাপটে চলে না।আমি কে ভুলে গেছো বুঝি?তেহজিব নূর শিকদার আমি।শিকদারেরা মন্ত্রী বানায়। মন্ত্রীদের ক্ষমতায় চলে না। তোমার কি মনে হয় লারা?পুকুরের পানি দিয়ে শিকদাররা এই সাগর বানিয়েছে? নর্দমায় থাকো তো।তাই এই বিশাল সাম্রাজ্য সম্পর্কে ধারণা নেই।
লুবানা,,,একে নর্দমায় ফেলে দিয়ে এসো।ম্যাডামের এতো ভালো পরিবেশ সহ্য হয় না।
লারা সাপের মতো ফোসফাস করতে লাগলো। শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষা। তখন দেখবে এতো ভাব কোথায় থাকে।
— ও ম্যাডাম। দরজা ওই দিকে।নাকি সিকিউরিটি ডাকতে হবে।
লারা লুবানার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল অফিস থেকে।
নূর চোখ বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে। লুবানা কিছু না বুঝলেও তার নূরের জন্য খারাপ লাগলো।আশমিন কে তার খারাপ মনে হয় নি। তার সাথে খুবই ভালো ব্যবহার করে। বড় ভাইয়ের মতো স্নেহ করে।নূরের সমস্ত খবরাখবর তার থেকেই নেয়।মাথা ঘুরতে শুরু করেছে লুবানার।
— আপনি ঠিক আছেন ম্যাম?
— হুম।আজকের মিটিং গুলো ক্যান্সেল করে দাও।আমি বাসায় যাচ্ছি।
লুবানা মাথা নেড়ে সায় জানালো। আশমিন আজ সারাদিন নূরের খবর নেয়ার সুযোগ পায়নি।মন্ত্রণালয়ে আটকে গেছে। ইদানীং নূরের শরীর খুব একটা ভালো থাকে না।খাওয়া দাওয়ার প্রচন্ড অরুচি। আশমিন জোর করে ও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারেনি। তাই আজ ডাক্তার বাসায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।তার বউ খাবার দেখে নাক মুখ কুচকে ফেলবে আর সে মুখ বুজে দেখবে তা হতে পারে না। এক বিয়ে করেই তার এই অবস্থা! বাবার মতো দুই বউ থাকলে না জানি কি হতো!
নূর বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে সোজা স্টাডি রুমে চলে গেলো। মায়া বেগম নূরের খাবার টা স্টাডি রুমেই পাঠিয়ে দিলো। বাসায় এখন আর একসাথে বসে খাওয়া দাওয়া হয় না।একেক জন একেক সময় খায়।কামিনী চৌধুরী কানাডা গিয়েছে দুই দিন আগে।মায়া বেগমের সাথে সে খারাপ ব্যবহার করে না। কোন কথা ও বলে না।আমজাদ চৌধুরীর সামনেও খুব কম পরে। আমজাদ চৌধুরী চাতক পাখির মতো বসে থাকে তাকে এক পলক দেখার জন্য। কিন্তু দিনে একবার ও দেখা পান না। মাঝে মাঝে সপ্তাহ পার হয়ে যায়। অপেক্ষা শেষ হয় না।
আশমিন বাড়িতে যখন ঢুকেছে তখন রাত দশটা।আমজাদ চৌধুরী সোফায় চোখ বুজে বসে আছে। কয়েকদিনে বয়স অর্ধেক বেড়ে গেছে।আশমিন ধপ করে গিয়ে তার পাশে বসে পরলো। গম্ভীর গলায় বলল,
স্টাডি রুমে বিধ্বস্ত হয়ে বসে আছে নূর। অনুভূতিহীন চোখে এক মনে তাকিয়ে আছে আশমিনের ডায়েরির দিকে।একটি মাত্র ডায়েরি জীবনের অনেক অসমাপ্ত গল্পের সমাপ্তি টেনে দিয়েছে।দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোর খামচে ধরে বসে আছে নূর। কান্না আটকানোর জন্য ঠোঁট কামড়ে ধরায় ঠোঁট কেটে র*ক্ত বেরিয়ে গেছে।ডায়েরি থেকে নজর সরিয়ে রক্তাক্ত চোখে তাকালো দেয়ালে টাঙ্গানো আশমিনের বিশাল ফ্রেমের ছবির দিকে। নিজেকে টেনে হিচড়ে দাড় করালো নূর। ডায়েরি টা জায়গা মতো রেখে আশমিনের ছবির সামনে এসে দাড়ালো।
— ধোকা! এত বড় ধোকা! (ছবিতে হাত বুলিয়ে) আপনাকে কি শাস্তি দেই বলুন তো মন্ত্রী সাহেব? কি নিখুঁত অভিনয় আপনার! আপনি তো নিজের পারফরম্যান্স দেখিয়ে দিলেন।এবার আমার টা দেখানোর পালা। অভিনয় করতে ভালো লাগে তাই না? তো চলুন,এক দফা টক্কর আমাদের মাঝেও হয়ে যাক(দাতে দাত চেপে)। আপনার চালে যদি আপনাকে মাত না দিয়েছি তো আমার নাম ও তেহজিব নূর শিকদার নয়।
আশমিন আসার পর থেকে নূর কে একবার ও দেখে নি। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে কপাল কুচকে চারিদিকে চোখ বুলালো সে।হাতের তাওয়াল টা বারান্দায় দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মায়া রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। আশমিন নিচে এসে অস্থির গলায় বলল,
— নূর কোথায় আন্টি?
— বউমা তো অনেকক্ষণ আগে স্টাডি রুমে গিয়েছে। দুপুরের খাবার টাও ওখানেই খেয়েছে। নিচে তো আসতে দেখিনি।
আশমিন ভয়ার্ত চোখে তাকালো মায়া বেগমের দিকে। হুশ ফিরতেই এক প্রকার দৌড়ে গেল স্টাডি রুমের দিকে। মায়া বেগম প্রথমে অবাক হলেও পরে মুচকি হেসে নিজের কাজে মন দিলো। শুধু বাড়ির লোক ই না, চেনা জানা সবাই জানে আশমিন নূর কে চোখে হারায়।শাজাহানের মতো নূরের জন্য নূরমহল বানিয়ে ফেললেও কেউ অবাক হবে না।সেফ কে নিজের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে রুমের দিকে গেলেন মায়া বেগম। শরীর টা আজ খুব একটা ভালো না।জ্বর আসবে হয়তো। আমজাদ চৌধুরী তার দিকে ফিরেও তাকায় না।তাতে অবশ্য তার কষ্ট হয় না। বরং এমন নিখাত ভালবাসা দেখে মনে মনে তৃপ্তি পায় সে।
হুড়মুড় করে স্টাডি রুমে ঢুকতেই নূর আশমিনের দিকে চোখ তুলে তাকালো। নূরের হাতে সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন বইটি। আশমিন স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। নূর মুচকি হেসে বই রেখে উঠে দাড়ালো। ধীর পায়ে কাছে এসে আশমিনের বুকে মাথা এলিয়ে দিলো। আশমিন ও আগলে নিলো নূর কে।হৃদপিণ্ডের তীব্র ধুকপুকানি নূরের কানে এসে বারি খাচ্ছে। নূর বাকা হাসলো, ব্যাঙ্গাত্মক গলায় বলল,
— ভয় পেয়েছেন নাকি মন্ত্রী সাহেব? এভাবে বুক কাপছে কেন?এভাবে তো অপরাধীর বুক কাপে। করেছেন নাকি কোন বড়সড় অপরাধ?
আশমিন হাত আলগা করে নূর কে নিজের সামনে আনলো।নূরের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নূরের চোখ একেবারে শান্ত।হাসি হাসি মুখে সে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন নিজেকে শান্ত করলো। নূর কে নিজের সাথে চেপে ধরে আস্তে করে বললো,
— অপরাধ তো করেছি বউ।আজ সারাদিন বউয়ের খবর নিতে পারিনি।এটা তো গুরুতর অপরাধ। শাস্তি তো পেতেই হবে।
— হুম,আমি দিবো আপনাকে শাস্তি। আজ সারা রাত আমার সাথে বারান্দায় গল্প করে কাটাতে হবে। শাস্তি মঞ্জুর তো মন্ত্রী সাহেব?
আশমিন চোখে হাসলো। নূরের কপালে চুমু খেয়ে ঘোর লাগা গলায় বলল,
— এমন শাস্তি আমি সারাজীবন পেতে চাই বউ।
আশমিনের কাছে আসায় গা গুলিয়ে উঠলো নূরের। নিজেকে ছাড়িয়ে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাড়ালো। আশমিন ভ্রু কুচকে ফেললো। নূরের ঠোঁটের দিকে চোখ যেতেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো তার। দ্রুত পায়ে এসে নূরের গাল চেপে ধরলো।কাটা জায়গায় স্লাইড করতে করতে বললো,
— এভাবে কাটলো কিভাবে? ঠোঁট কামড়েছো কেন?এখন আমি চুমু খাবো কোথায়?
প্রথম কথা গুলো রাগ করে বললেও শেষ কথা টা দুঃখী দুঃখী গলায় বলল আশমিন। নূর শান্ত চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। অভিনয়েও বুঝি ভালবাসা এতো নিখুঁত হয়!
— এই মেয়ে,কথা বলছো না কেন?
আশমিনের ধমকের পিঠে কিছু বলার আগেই মাথা ঘুরে উঠলো নূরের। ঝাপসা চোখে একবার আশমিনের দিকে তাকিয়ে ঢলে পরতেই আশমিন আগলে নিলো নূর কে। অস্থির গলায় ডাকতে লাগলো,, — বউ!কি হয়েছে তোমার? নূররর,,,,
নূর কে কোলে তুলে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতেই চিৎকার করে সবাই কে ডাকলো আশমিন।বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে অস্থির হয়ে ফোন করলো ডক্টর কে।ততক্ষণে বাড়ির সবাই এসে পড়েছে।লুবানা গিয়ে নূরের হাত পা মালিশ করতে লাগলো। মায়া বেগম চোখে পানি ছিটিয়ে দিলেও নূরের জ্ঞান ফিরলো না।আশমিন পাগলের মতো নূর কে ডেকে যাচ্ছে বারবার। লুবানার ছোট ভাই লিমন এক কোনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সে আশমিন কে ভয় পায়।এখন আশমিনের পাগলামি দেখে আরো ভয়ে সিটিয়ে গিয়েছে।আমজাদ চৌধুরী চিন্তিত গলায় বলল,
— এভাবে বসে থেকো না। ওকে হসপিটাল নিয়ে যাও।
আশমিন আর এক মুহুর্ত দেড়ি করলো না।নূর কে কোলে তুলে রুম থেকে বেরুতেই সানভি হন্তদন্ত পায়ে প্রবেশ করলো ডক্টর নিয়ে।আশমিন আবার নূর কে রিমে নিয়ে শুয়িয়ে দিলো।সবাই কে বেরিয়ে যেতে বলতেই আশমিনের ভয়ংকর দৃষ্টিতে দমে গেল ডক্টর। সবাই বেরিয়ে গেল ও আশমিম নূরের হাত ধরে তার পাশেই বসে রইলো। ডক্টর চেকআপ করে মুচকি হেসে আশমিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
— অভিনন্দন স্যার।সি ইজ প্রেগন্যান্ট। অতিরিক্ত চিন্তার জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন।এখন ওনার রেস্ট প্রয়োজন। আমি ইঞ্জেকশন দিয়ে দিচ্ছি। কাল সকালের আগে ঘুম ভাঙ্গবেনা।কাল হসপিটালে গিয়ে কিছু টেস্ট করিয়ে আনবেন।তাহলে ম্যামের কন্ডিশন ভালো ভাবে বোঝা যাবে।
ডক্টরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আশমিন।তার কানে শুধু একটা কথাই বাজছে,”সি ইজ প্রেগন্যান্ট “ডাক্তারের বাকি কথা তার কানে গেলো কি না বোঝা গেলো না।ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিতেই ডাক্তার মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল। আশমিন একমনে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে। নূরের চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। আশমিনের হাতের মুঠোয় থাকা নূরের হাতটার কয়েকটা নখ ভেঙে গিয়েছে। আশমিন হালকা ঝুকে জরিয়ে ধরলো নূর কে।উত্তেজনায় তার পুরো শরীর কাপছে। মনে হচ্ছে সে জ্ঞান হারাবে।
নিচে লুবানার চিৎকার শোনা যাচ্ছে। সানভি ধমকেও তাকে থামাতে পারছেনা।
— এভাবে চিৎকার করছো কেন সাবানা?অসভ্যের মতো চিৎকার করা বন্ধ করো।ছিঃ, কি গলা।মনে হচ্ছে ফাটা বাসের ভিতর আটকে পরা ইদুর কিচমিচ করছে।
লুবানা সমস্ত আনন্দ ভুলে ফুসে উঠলো। কটমট করে তাকালো সানভির দিকে।
— ও হ্যালো,মি.কবরস্থানের বাসিন্দা। আমার নাম লুবানা।লু,,বা,,না।নট সাবানা। আর আমার গলা মোটেও ইদুরের মতো নয়।আপনার কানে সমস্যা।লক্কর ঝক্কর যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘুরে বেরাতে লজ্জা করে না আপনার?তাজ্জব ব্যাপার!
সানভি রাগী চোখে তাকিয়ে আছে লুবানার দিকে। মেয়ের সাহস দেখে অবাক হচ্ছে সে।আর এদিকে লিমন দুজনের ঝগড়া দেখছে আর হাই তুলছে।আমজাদ চৌধুরী আর মায়া বেগম নূরের রুমে গিয়েছে। না হলে ইজ্জত পানি পানি হয়ে যেতো এই মেয়ের জন্য।
— দেখো মেয়ে,, বেশি বারাবাড়ি করবে না। না হলে ছাদে তুলে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিবো।বেয়াদবির একটা আদব থাকা দরকার।
— হুহ,,আসছে ধাক্কা দিতে।বলি হাড়গোড় সব ঠিক যায়গায় আছে তো?আগে চেক করে আসুন।দেখা গেলো চোখ কানের মতো হাড্ডি ও দুই একটা কবরে রেখে এসেছেন।
লুবানা মুখ বাকিয়ে চলে গেলো। সানভি কটমট করতে করতে লিমন কে বললো,
— দেখেছো? দেখেছো কেমন বেয়াদব?
লিমন হচকচিয়ে গেলো। জোর পুর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,
— জ্বি ভাইয়া।ছোট বেলা থেকেই দেখছি।
আশমিনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আমজাদ চৌধুরী।ছলের খুশির পরিমাণ তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আশমিন আমজাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে দাম্ভিক হাসি দিলো।আমজাদ চৌধুরী ভ্রু কুচকে তাকালো ছেলের দিকে। নিশ্চিত এখন বেহায়া মার্কা কিছু বলবে।এখানে মায়া বেগম ও আছে।আমজাদ চৌধুরী আর লজ্জায় পরতে চাইলো না। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিতেই আশমিন তার কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
আমার জীবন বিডিতে নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন, প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url