ইট পাটকেল পর্ব ১৬ - ইট পাটকেল সকল পর্বের লিংক
হাসপাতালে গম্ভীর মুখে বসে আছে আশমিন। নূর কে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেছে দুই ঘন্টা হতে চললো। আশমিন তখন থেকেই থম ধরে বসে আছে। আট মাসেই সিজার করে ফেলতে হচ্ছে। নূরের কন্ডিশন ভালো ছিল না। একজন হলে সমস্যা হতো না। টুইনস বেবি হওয়ায় সিজার করে ফেলতে হচ্ছে। বাচ্চা উল্টে গেছে।
আরো পড়ুন : ইট পাটকেল পর্ব ১
নূর কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল সন্ত্রাসীরা।তখন পেটে আঘাত লাগায় রক্তপাত শুরু হয়।নূর কিডন্যাপ হওয়ার দুই ঘন্টা পরে আশমিন নূরের কাছে পৌঁছেছে।বেবিদের কোন ক্ষতি হয়নি।ব্লিডিং বন্ধ না হওয়ায় এখনি সিজার করতে হচ্ছে। নূরের শরীরের কন্ডিশন খুব একটা ভালো না।আশমিন অমি দের সাথেই একজন ডক্টর পাঠিয়ে ছিল।সে চেকআপ করে নূরের কন্ডিশন বলতেই আশমিন সাথে সাথে নূর কে হসপিটাল নিয়ে এসেছে।
আরো পড়ুন : ইট পাটকেল পর্ব ১
ইট পাটকেল পর্ব ২
ইট পাটকেল পর্ব ৩
ইট পাটকেল পর্ব ৪
ইট পাটকেল পর্ব ৫
ইট পাটকেল পর্ব ৬
ইট পাটকেল পর্ব ৭
ইট পাটকেল পর্ব ৮
ইট পাটকেল পর্ব ৯
ইট পাটকেল পর্ব ১০
ইট পাটকেল পর্ব ১১
ইট পাটকেল পর্ব ১২
ইট পাটকেল পর্ব ১৩
ইট পাটকেল পর্ব ১৪
ইট পাটকেল পর্ব ১৫
ইট পাটকেল পর্ব ১৬
ইট পাটকেল পর্ব ১৭
ইট পাটকেল পর্ব ১৮
ইট পাটকেল পর্ব ১৯
ইট পাটকেল পর্ব ২০
ইট পাটকেল পর্ব ২১
ইট পাটকেল পর্ব ২২
ইট পাটকেল পর্ব ২৩
ইট পাটকেল শেষপর্ব ২৪
অমি অস্থির হয়ে পায়চারি করছে।আশমিন কে এতো শান্ত দেখে অবাকের সাথে সাথে মেজাজ ও খারাপ হচ্ছে। নূর কে নিয়ে আশমিনের কোন মাথা ব্যথা ই নেই!সানভি মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে।নূরের জন্য তার খুব খারাপ লাগছে। লুবানা পাশে দাঁড়িয়ে গুন গুন করে কেদে যাচ্ছে। সানভি বিরক্ত চোখে তাকিয়ে চোখ মুখ কুচকে ফেললো। এই মেয়েকে দেখে তার মাথা ব্যথা হচ্ছে।
আশমিনের ফোন বাজতেই কয়েক জোড়া চোখ তার দিকে স্থির হয়ে গেলো। আশমিন ফোন রিসিভ করে একটু দূরে গিয়ে দাড়ালো।
— বলো বাহাদুর।
— নাফিজা ম্যামের খবর পেয়েছি ম্যাম।
— আচ্ছা। এড্রেস পাঠিয়ে দাও।
— এদের কি করবো স্যার?(আমতা আমতা করে)
— মে*রে দাও।এতো গুলো পি*স করো যে বোঝা না যায় এরা মানুষ ছিল।
আশমিনের শান্ত গলায় এমন ভয়ংকর কথা শুনে শুকনো ঢোক গিললো বাহাদুর। সে জানে আশমিন কতটা ভয়ংকর। মনে মনে একটু আফসোস হলো এদের জন্য।
— মা*রার আগে মেয়ে গুলোর খোজ নিয়ে নিবে। এদের হদিশ যেন কাক পক্ষি ও টের না পায়।
বাহাদুর সম্মতি দিয়ে ফোন কেটে দিল। আশমিন গিয়ে আবার আগের যায়গায় বসে পরলো। অপারেশন থিয়েটারের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে চুপ করে বসে রইলো। সানভি আশমিনের বসার জন্য ভিআইপি ক্যাবিন নিলেও আশমিন সেখানে যায় নি।তার ভিতরের অস্থিরতা সে কাউকে দেখাতে পারছে না।দম বন্ধ হয়ে আসছে।হুট করেই বসা থেকে দুম করে দাঁড়িয়ে গেলো আশমিন। অপারেশ থিয়েটারের দরজায় নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিতে লাগলো। অমি এসে আগলে ধরলো আশমিন কে। আশমিনের সারা শরীর কাপছে।এতক্ষণ নিজেকে সামলে রাখলে ও এখন আর তার সহ্য হচ্ছে না। নূর কি অবস্থায় আছে না দেখা পর্যন্ত শান্তি নেই তার।বুকের ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। বুকের যন্ত্রণায় তার শ্বাস আটকে আসছে। আশমিন কে অমি ধরে রাখতে পারছে না।আশমিনের শক্তির সাথে তার মতো দুইটা অমিও কিছু না। সানভি ভয়ে সামনে যাচ্ছে না। লুবানা শব্দ করে কাদছে।
— দরজা খোল,,আমি ভিতরে যাবো।
আশমিনের হুংকার শুনে একজন নার্স দরজা খুলে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো আশমিনের দিকে। সব সময় শান্ত থাকা মানুষ টা কে এভাবে ভয়ংকর রুপে দেখে গলা শুকিয়ে গেলো তার।আশমিন নার্স কে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলো। নূর কে অপারেশন টেবিলে দেখে তার অশান্ত চোখ গুলো আপনা আপনি শান্ত হয়ে গেলো। ডাক্তার অপারেশন বাদ দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন ইশারায় তার কাজ করতে বলে নূরের মাথার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নূরের ফ্যাকাসে মুখের দিকে। অক্সিজেন মাক্স লাগানো নূর কে দেখে চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এলো। কপালে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আশমিন। বুকের ব্যথা ক্রমশ বাড়ছে। বুকে কয়েক বার হাত বুলিয়ে অসহায় চোখে চারিদিকে চোখ বুলালো। সে অসুস্থ হতে চায় না এখন। নূরের পাসে থাকতে চায়।কিন্তু শরীর সায় দিচ্ছে না। বউয়ের সিজার দেখে সে বুক ব্যথায় মরে যাচ্ছে। এমন দুর্বল মন্ত্রী দিয়ে দেশ চলবে!কি লজ্জাজনক ব্যপার।
বাচ্চার হালকা কান্নার আওয়াজে ধ্যান ফিরলো আশমিনের।বুকের ব্যথা ভুলে সেদিকে তাকিয়ে চোখ স্থির হয়ে গেলো। দুজন নার্সের কোলে দুটো রাজকন্যা। রক্তে মাখামাখি তাদের ছোট্ট শরীর পরিস্কার করে তার কাছে নিয়ে এলো বাচ্চাদের।আশমিন শুধু এক পলক দেখার সুযোগ পাবে।তার পর তাদের এনআইসিউ তে নিয়ে যাবে।ওখানেই পনের দিন রাখার পরে তাদের মায়ের কাছে দেয়া হবে। আশমিন একপলক দেখে বাচ্চাদের নিজের কোলে নিলো।নার্স কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। আশমিন কে কিছু বলার ক্ষমতা নেই তাদের।একজন হ্যান্ড স্যানিটাইজার করতে বললো মিনমিন করে। আশমিন বাচ্চাদের দিয়ে নিজের হাত স্যানিটেশন করে আবার তাদের কোলে নিলো।দুজনের কানের কাছে আজান দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে তাদের আবার নার্সদের কোলে দিয়ে দিলো।
— অপারেশন হয়ে গেছে স্যার।ম্যাম কে কিছুক্ষণ পরে কেবিনে সিফট করা হবে। আপনি যদি একটু,,
শেষের কথা টা আমতা আমতা করে বলতে গিয়েও থেমে গেলো ডাক্তার।আশমিন আর কিছু বললো না। নূরের কপালে চুমু খেয়ে চুপচাপ বেরিয়ে এলো। বুকের ব্যথা টা এখন কমেছে।প্রিন্সেসদের কোলে নিয়ে অর্ধেক কমে গেছে। বউকে বুকে নিলে পুরোটা চলে যাবে নিশ্চিত। অমি সানভি আর লুবানা বাচ্চাদের দেখে এসেছে একপলক। উত্তেজনায় কখন সানভির হাত জরিয়ে ধরেছে নিজেও টের পায়নি। সানভি লুবানার বাচ্চামো দেখে হালকা হাসলো। রাগ করার ভান করে বললো,
— এই হাত ছাড়ো সাবানা।তোমাকে বিশ্বাস নেই।এখন হাত ধরছো একটু পরে গলা ধরতে আসবে। আমি কোন দুই ইঞ্চি লিলিপুট কে আমার গলা জরিয়ে ধরতে দিবো না। নারী কেলেংকারী হলেও মেনে নেয়া যাবে। কিন্তু বাচ্চা কেলেংকারি হলে আমি মুখ দেখাতে পারবো না।আল্লাহর দোহায় লাগে আমাকে ছেড়ে দাও।
লুবানা ঝামটা দিয়ে সানভির হাত ছেড়ে দিলো। কটমট করতে করতে বললো,
— এমন একটা ভাব করছেন জেন আমি আপনার ইজ্জত লুটে নিচ্ছি। ফালতু যত্তসব। আর আমার নাম লুবানা। আরেকদিন সাবানা বললে আপনাকে সাবান দিয়ে মুচড়ে মুচড়ে ধুয়ে দিবো আমি। ল্যাব পিপলস।
লুবানা গটগট করে চলে গেলো। সানভি বিরস মুখে তাকিয়ে দেখলো তার চলে যাওয়া। অমি কপাল চাপড়ে বললো,
— সমস্যা কি তোমাদের।সতিনের মতো সারাদিন একজন আরেকজনের পিছনে লেগে থাকো কেন?আর এই ল্যাব পিপলস মানে কি?(অবাক হয়ে)
— আমার কংকাল ল্যাবে দান করা হয়েছে।তাই আমি ল্যাব পিপলস। (শ্বাস ছেড়ে)
— মানে??
— লম্বা কাহিনি। বাদ দাও।
— হুম।
আমজাদ চৌধুরী হসপিটালে এসেছে পাচ মিনিট হলো। আশমিন হাসপাতালের বিলাসবহুল কেবিনে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে। সারাদিনের চিন্তা ক্লান্তি চিন্তায় শরীর ভার ছেড়ে দিয়েছে।আমজাদ চৌধুরীর খারাপ লাগলো ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে।বাড়ি তে নাচতে থাকা বিপদের কথা কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না।কামিনী চৌধুরীর উপর বিতিষ্ণা চলে এসেছে। তবুও সে ঘৃণা করতে পারে না তাকে।একেই বুঝি ভালবাসা বলে।
— বউ ছেড়ে আসতে মন চাইলো?তুমি তো দিন দিন বউ পাগল হয়ে যাচ্ছো।পুরুষ মানুষের এমন বউ পাগল হলে চলে!
আশমিনের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো আমজাদ চৌধুরী।কে এই কথা বলছে! যে নিজেই সারাদিন বউয়ের আগে পিছে ঘুরঘুর করে।
— ক্লান্ত লাগছে আব্বু।
আমজাদ চৌধুরীর মায়া হলো। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় বললো,
— নূরের কি অবস্থা?
— ভালো।
— আমার নাতনি রা কেমন আছে?
— আলহামদুলিল্লাহ ভালো আব্বু।এই এটুকু হয়েছে(হাত দিয়ে ইশারা করে) আশমিন জায়িন চৌধুরীর মেয়েরা কিনা ইদুরের বাচ্চার সাইজ নিয়ে দুনিয়ায় এলো! ওদের কান্না ও ঠিক ভাবে শুনতে পাচ্ছিলাম না।চোখ খুলে আমাকে দেখেনি ওরা।আমার নূরের কতো কষ্ট হয়েছে! সব কয়টা কে কুকুর দিয়ে খাওয়াবো আমি।কার কলিজায় হাত দিয়েছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাবে।(দাতে দাত চেপে)
নূরের জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই নূর অস্থির হয়ে আছে বাচ্চাদের জন্য। আশমিন বুঝিয়ে ও রাখতে পারছে না। অপারেশনের পর নূরের বেশি নড়াচড়া করা নিষেধ। সে মেয়ে এখন চিংড়ি মাছের মতো তিরিং বিরিং করছে।প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো আশমিনের।জোড়ে ধমক দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। মুখে হালকা হাসি টেনে দাতে দাত চেপে বললো,
— চুপচাপ শুয়ে থাকো বউ।আমার মেজাজ খারাপ হলে খুব খারাপ হবে।মেয়েদের জন্য এতো উতলা হয়ো না।বছর বছর এই অনুভূতি পাওয়ার সুযোগ পাবে তো তুমি।তোমার বরের মন অনেক বড়। সে তোমাকে টুইনস বেবির মা বানাবে।এবার চুপ করে ঘুমাও সোনা।একটু সুস্থ হলে পরিদের কাছে নিয়ে যাবো। এখন আমাকে একটা চুমু খাও।আমি চুমু শূন্যতায় ভুগছি।
নূর ব্যথা অস্থিরতা বাদ দিয়ে আশমিনের দিকে কটমট করে তাকালো। কোমরের নিচের অংশ এখনো অবস হয়ে আছে। সুস্থ হলে সবার আগে এই লোক কে পিটিয়ে হাতের সুখ করে নিবে।অসহ্য মানুষ একটা।
নূরের খেয়ে ফেলা লুক দেখে আশমিন এদিক ওদিক তাকিতুকি করলো।গলা ঝেড়ে দুঃখী গলায় বলল,
— এভাবে তাকাচ্ছো কেন? আমি কতো টেনশনে ছিলাম জানো? এই বারান্দায় কতো বার চক্কর লাগিয়েছি ধারণা আছে? তোমার জন্য আমার ব্যক্তিগত বুকে পোষা মীরজাফর কলিজা লাফিয়ে বাইরে চলে আসছিল প্রায়!কতো কষ্টে চেপে চুপে আটকে রেখেছি হিসেব আছে! আর এখন তুমি আমাকে চোখ দেখাচ্ছো! মানবতা আজ কোথায়? আজকেই মানবাধিকার কমিশনে একটা লিখিত অভিযোগ জানাতে হবে। আমি গাল এগিয়ে দিচ্ছি চুপচাপ চুমু খাও।নাহলে আমি জোর করে ও নিতে পারি।
নূর চোখ বুজে রইলো। কথা বলার ইচ্ছা আগ্রহ কোনটাই নেই।এই লোকের রেললাইনের মতো মুখ লাগাম ছাড়া চলতেই থাকে।
নূর কে চোখ বন্ধ করতে দেখে বিজয়ের হাসি হাসলো আশমিন। যাক, আপাতত শান্ত করা গেছে।এটা কে বলে প্রতিভা। বউ কে চুপ করানো তার কাছ থেকে শিখা উচিত। সময় থাকলে একটা কোচিং সেন্টার খোলা যেতো। আহা!কতো অসহায় স্বামীদের উপকার হতো। এটা ও একপ্রকার জনসেবা।
সানভি আশমিন কে ম্যাসেজ করলো বাইরে আসার জন্য। আশমিন আজ দুই দিন কিছুই মুখে দেয়নি।তার উপর তার বুকের ব্যথা ক্রমশ বাড়ছে। ডাক্তার কয়েকটা টেস্ট দিয়েছে।কিন্তু আশমিন নূরের কেবিনে ঘাপটি মেরে বসে আছে। অমি কাল সারাক্ষণ এখানে ছিল।সকালে লুবানা কে নিয়ে বাসায় গিয়েছে। একেবারে অফিস করে বিকেলে আসবে।আগামী কয়েকদিনের দলীয় সমস্ত মিটিং ক্যানসেল করেছে আশমিন।অফিস আমজাদ চৌধুরী সামলে নিবেন।
সানভির মেসেজ পেয়ে বেরিয়ে এলো আশমিন। চোখে মুখে ক্লান্তি চেপে ধরেছে।সানভি নিজেও ক্লান্ত।
— আপনার পোশাক নিয়ে এসেছি স্যার।ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নিন। খাবার রেডি আছে।একবার টেস্ট করিয়ে নিতে হবে।আর না করবেন না স্যার প্লিজ।
সানভির করুন গলা শুনে মলিন হাসলো আশমিন। উদাশ চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে মলিন গলায় বলল,
— মানুষ চোখের ভালবাসা কেন অনুভব করে না সান?চোখ তো মনের আয়না। ভালবাসার মানুষ টা আমার চোখে থাকা ভালবাসা, অভিমান, কষ্ট অনুভব করতে পারে না এই পরাজয় আমি কিভাবে মেনে নেই সান? সে আমাকে কষ্ট দেক।আঘাত করুক।আমি মেনে নিবো।কিন্তু সে আমার চোখের ভাষা বোঝে না এটা আমি কিভাবে সহ্য করি বলো তো? আমার মনে রাজ করা মানুষ টার ভালবাসায় এতো ক্ষাদ আমার সহ্য হচ্ছে না। ছোট বেলা থেকেই আমি শুধু অবহেলা পেয়ে গেলাম বুঝলে? আপনজনদের অবহেলা নিতে নিতে আমি ক্লান্ত।তুমি কোন ব্যথা সারাবে সান? এই বুকে সারাক্ষণ আমার প্রিয় মানুষ গুলো আঘাত করে চলেছে। ক্ষত সারাতে মলম দিতে হয়।পুনোরায় একই জায়গায় আঘাত করলে কি ক্ষত সারবে? এসব বাদ দাও। বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও। প্রয়োজন হলে আমি ডেকে নিবো।
আশমিন আবার নূরের কেবিনে চলে গেলো। সানভি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আশমিনের কষ্ট সে বোঝে।এতো বছর ছায়ার মতো লেগে আছে তার পিছনে। আশমিনের প্রতিটি নির্ঘুম রাতের সাক্ষী সে।কি গভীর যন্ত্রণায় মাঝ রাতে বারান্দায় ডুকরে কেদে উঠতো আশমিন। এমন শক্ত পোক্ত গম্ভীর মানুষ টা কে রাতের আধারে কাদতে দেখে নিজের চোখ ও ভিজে উঠতো সানভির।নূরের প্রতিটি কথা আশমিন কে গভীর ভাবে আঘাত করে। আশমিন হাসি মুখে এড়িয়ে যাওয়ার ভান করলেও সানভি বোঝে তার স্যার হাসি মুখে আঘাতের বি*ষ পান করছে। মাঝে মাঝে সানভির খুব আফসোস হয় নূরের জন্য। এমন একটা ভালবাসার মানুষ পেয়ে ও সে অবহেলা করছে।যদি কখনো হারিয়ে যায় কেদেও কুল পাবে না।
পনের দিন পরে আজ নিজের মেয়েদের কাছে পেয়েছে নূর।সে নিজেও পুরো পুরি সুস্থ না।তাই এখনো হসপিটালে আছে।আমজাদ চৌধুরী প্রতিদিন এসে নাতনিদের দেখে যান।কামিনী চৌধুরী একবার ও আসেনি।মায়া বেগম কয়েকবার এসেছে।আশমিন কড়া গলায় তাকে বাসায় থাকতে বলেছে।তার একমাত্র কাজ হচ্ছে কামিনী চৌধুরীর উপর নজর রাখা। আর কোন ছাড় দেয়া হবে না কামিনী চৌধুরী কে।
বাচ্চাদের নিজের কোলে নিয়ে কেদে ফেললো নূর।আশমিন চোখ ভরে দেখছে তার রাজকুমারীদের। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখের মুহুর্ত বুঝি এটাই।একজন নার্স এসে নূর কে ফিডিং করাতে বললে নূর উসখুস করতে লাগলো। আড় চোখে আশমিনের কয়েকবার তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিচ্ছে।আশমিন তীক্ষ্ণ চোখে নূরের দিকে তাকিয়ে আছে। নার্স আবার তারা দিতেই নূর আমতা আমতা করে বললো,
— ওনাকে বাইরে যেতে বলুন।
আশমিন যেন এই কথার অপেক্ষায় ই ছিল।সাথে সাথে গম্ভীর গলায় নার্স কে উদ্দেশ্য করে বললো,
— আউট।
নার্স কোন দিরুক্তি না করেই বেরিয়ে গেল। নূর হতভম্ব গলায় বলল,
— আরে আমি আপনাকে বলেছি।
— আমি থাকতে তাকে কেন লাগবে? আমি হেল্প করছি। আমাদের মধ্যে প্রাইভেসি বলতে কিছু নেই।এই মুহুর্ত গুলো খুব অমূল্য নূর। তোমার এই সুখের কষ্টে আমি তোমার সহযোদ্ধা।তোমার জন্য আমি ই যথেষ্ট।
কথা বলতে বলতেই নূর কে হেল্প করে মাথার পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো আশমিন।
— বসতে কষ্ট হচ্ছে?
নূর মাথা নাড়িয়ে না বললো। আশমিনের চোখের দিকে তাকালে তার বিশ্বাস হয়না সে তার বাবাকে খু*ন করেছে।তবে আশমিনের খাপছাড়া ভাব আর স্বিকারউক্তি তার ভাবনা গুলুকে বারবার এলোমেলো করে দেয়। এই দোটানায় সে নিজেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। আশমিন যদি সত্যি তার বাবাকে খু*ন করে থাকে তাহলে তাকে মরণ যন্ত্রণা দিবে সে। একবার সঠিক তথ্য তার হাতে আসুক। একটা ডায়েরির উপর ভিত্তি করে কোন পদক্ষেপ নেয়া উচিত হবে না। আর রইলো আশমিনের স্বিকার উক্তি,আশমিনের মতো বদ লোকের কোন কথা ধরা মানে নিজের মাথা দেয়ালে মারা।আস্তো ইতর একটা।
— আমার ডাক্তার হওয়া উচিত ছিল বউ।ওই ডাক্তার আমার বউয়ের পেট কেটে দুই ভাগ করে ফেললো আর আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম! ডাক্তার হলে কি এই দিন দেখতে হতো বলো? বউ ও আমার বউয়ের পেট ও আমার।আর কাটলো কি না ডাক্তার! শুধু আমার রাজকন্যা গুলোর জন্য কিছু বললাম না। নাহলে আমিও ওই ডাক্তারের পেট কেটে দিতাম। মিনিস্টার আশমিন জায়িন চৌধুরীর বউয়ের পেট কেটে ফেলে! কি সাহস ভাবা যায়?
আশমিনের ফোন বাজতেই কয়েক জোড়া চোখ তার দিকে স্থির হয়ে গেলো। আশমিন ফোন রিসিভ করে একটু দূরে গিয়ে দাড়ালো।
— বলো বাহাদুর।
— নাফিজা ম্যামের খবর পেয়েছি ম্যাম।
— আচ্ছা। এড্রেস পাঠিয়ে দাও।
— এদের কি করবো স্যার?(আমতা আমতা করে)
— মে*রে দাও।এতো গুলো পি*স করো যে বোঝা না যায় এরা মানুষ ছিল।
আশমিনের শান্ত গলায় এমন ভয়ংকর কথা শুনে শুকনো ঢোক গিললো বাহাদুর। সে জানে আশমিন কতটা ভয়ংকর। মনে মনে একটু আফসোস হলো এদের জন্য।
— মা*রার আগে মেয়ে গুলোর খোজ নিয়ে নিবে। এদের হদিশ যেন কাক পক্ষি ও টের না পায়।
বাহাদুর সম্মতি দিয়ে ফোন কেটে দিল। আশমিন গিয়ে আবার আগের যায়গায় বসে পরলো। অপারেশন থিয়েটারের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে চুপ করে বসে রইলো। সানভি আশমিনের বসার জন্য ভিআইপি ক্যাবিন নিলেও আশমিন সেখানে যায় নি।তার ভিতরের অস্থিরতা সে কাউকে দেখাতে পারছে না।দম বন্ধ হয়ে আসছে।হুট করেই বসা থেকে দুম করে দাঁড়িয়ে গেলো আশমিন। অপারেশ থিয়েটারের দরজায় নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিতে লাগলো। অমি এসে আগলে ধরলো আশমিন কে। আশমিনের সারা শরীর কাপছে।এতক্ষণ নিজেকে সামলে রাখলে ও এখন আর তার সহ্য হচ্ছে না। নূর কি অবস্থায় আছে না দেখা পর্যন্ত শান্তি নেই তার।বুকের ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। বুকের যন্ত্রণায় তার শ্বাস আটকে আসছে। আশমিন কে অমি ধরে রাখতে পারছে না।আশমিনের শক্তির সাথে তার মতো দুইটা অমিও কিছু না। সানভি ভয়ে সামনে যাচ্ছে না। লুবানা শব্দ করে কাদছে।
— দরজা খোল,,আমি ভিতরে যাবো।
আশমিনের হুংকার শুনে একজন নার্স দরজা খুলে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো আশমিনের দিকে। সব সময় শান্ত থাকা মানুষ টা কে এভাবে ভয়ংকর রুপে দেখে গলা শুকিয়ে গেলো তার।আশমিন নার্স কে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলো। নূর কে অপারেশন টেবিলে দেখে তার অশান্ত চোখ গুলো আপনা আপনি শান্ত হয়ে গেলো। ডাক্তার অপারেশন বাদ দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন ইশারায় তার কাজ করতে বলে নূরের মাথার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নূরের ফ্যাকাসে মুখের দিকে। অক্সিজেন মাক্স লাগানো নূর কে দেখে চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এলো। কপালে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আশমিন। বুকের ব্যথা ক্রমশ বাড়ছে। বুকে কয়েক বার হাত বুলিয়ে অসহায় চোখে চারিদিকে চোখ বুলালো। সে অসুস্থ হতে চায় না এখন। নূরের পাসে থাকতে চায়।কিন্তু শরীর সায় দিচ্ছে না। বউয়ের সিজার দেখে সে বুক ব্যথায় মরে যাচ্ছে। এমন দুর্বল মন্ত্রী দিয়ে দেশ চলবে!কি লজ্জাজনক ব্যপার।
বাচ্চার হালকা কান্নার আওয়াজে ধ্যান ফিরলো আশমিনের।বুকের ব্যথা ভুলে সেদিকে তাকিয়ে চোখ স্থির হয়ে গেলো। দুজন নার্সের কোলে দুটো রাজকন্যা। রক্তে মাখামাখি তাদের ছোট্ট শরীর পরিস্কার করে তার কাছে নিয়ে এলো বাচ্চাদের।আশমিন শুধু এক পলক দেখার সুযোগ পাবে।তার পর তাদের এনআইসিউ তে নিয়ে যাবে।ওখানেই পনের দিন রাখার পরে তাদের মায়ের কাছে দেয়া হবে। আশমিন একপলক দেখে বাচ্চাদের নিজের কোলে নিলো।নার্স কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। আশমিন কে কিছু বলার ক্ষমতা নেই তাদের।একজন হ্যান্ড স্যানিটাইজার করতে বললো মিনমিন করে। আশমিন বাচ্চাদের দিয়ে নিজের হাত স্যানিটেশন করে আবার তাদের কোলে নিলো।দুজনের কানের কাছে আজান দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে তাদের আবার নার্সদের কোলে দিয়ে দিলো।
— অপারেশন হয়ে গেছে স্যার।ম্যাম কে কিছুক্ষণ পরে কেবিনে সিফট করা হবে। আপনি যদি একটু,,
শেষের কথা টা আমতা আমতা করে বলতে গিয়েও থেমে গেলো ডাক্তার।আশমিন আর কিছু বললো না। নূরের কপালে চুমু খেয়ে চুপচাপ বেরিয়ে এলো। বুকের ব্যথা টা এখন কমেছে।প্রিন্সেসদের কোলে নিয়ে অর্ধেক কমে গেছে। বউকে বুকে নিলে পুরোটা চলে যাবে নিশ্চিত। অমি সানভি আর লুবানা বাচ্চাদের দেখে এসেছে একপলক। উত্তেজনায় কখন সানভির হাত জরিয়ে ধরেছে নিজেও টের পায়নি। সানভি লুবানার বাচ্চামো দেখে হালকা হাসলো। রাগ করার ভান করে বললো,
— এই হাত ছাড়ো সাবানা।তোমাকে বিশ্বাস নেই।এখন হাত ধরছো একটু পরে গলা ধরতে আসবে। আমি কোন দুই ইঞ্চি লিলিপুট কে আমার গলা জরিয়ে ধরতে দিবো না। নারী কেলেংকারী হলেও মেনে নেয়া যাবে। কিন্তু বাচ্চা কেলেংকারি হলে আমি মুখ দেখাতে পারবো না।আল্লাহর দোহায় লাগে আমাকে ছেড়ে দাও।
লুবানা ঝামটা দিয়ে সানভির হাত ছেড়ে দিলো। কটমট করতে করতে বললো,
— এমন একটা ভাব করছেন জেন আমি আপনার ইজ্জত লুটে নিচ্ছি। ফালতু যত্তসব। আর আমার নাম লুবানা। আরেকদিন সাবানা বললে আপনাকে সাবান দিয়ে মুচড়ে মুচড়ে ধুয়ে দিবো আমি। ল্যাব পিপলস।
লুবানা গটগট করে চলে গেলো। সানভি বিরস মুখে তাকিয়ে দেখলো তার চলে যাওয়া। অমি কপাল চাপড়ে বললো,
— সমস্যা কি তোমাদের।সতিনের মতো সারাদিন একজন আরেকজনের পিছনে লেগে থাকো কেন?আর এই ল্যাব পিপলস মানে কি?(অবাক হয়ে)
— আমার কংকাল ল্যাবে দান করা হয়েছে।তাই আমি ল্যাব পিপলস। (শ্বাস ছেড়ে)
— মানে??
— লম্বা কাহিনি। বাদ দাও।
— হুম।
আমজাদ চৌধুরী হসপিটালে এসেছে পাচ মিনিট হলো। আশমিন হাসপাতালের বিলাসবহুল কেবিনে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে। সারাদিনের চিন্তা ক্লান্তি চিন্তায় শরীর ভার ছেড়ে দিয়েছে।আমজাদ চৌধুরীর খারাপ লাগলো ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে।বাড়ি তে নাচতে থাকা বিপদের কথা কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না।কামিনী চৌধুরীর উপর বিতিষ্ণা চলে এসেছে। তবুও সে ঘৃণা করতে পারে না তাকে।একেই বুঝি ভালবাসা বলে।
— বউ ছেড়ে আসতে মন চাইলো?তুমি তো দিন দিন বউ পাগল হয়ে যাচ্ছো।পুরুষ মানুষের এমন বউ পাগল হলে চলে!
আশমিনের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো আমজাদ চৌধুরী।কে এই কথা বলছে! যে নিজেই সারাদিন বউয়ের আগে পিছে ঘুরঘুর করে।
— ক্লান্ত লাগছে আব্বু।
আমজাদ চৌধুরীর মায়া হলো। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় বললো,
— নূরের কি অবস্থা?
— ভালো।
— আমার নাতনি রা কেমন আছে?
— আলহামদুলিল্লাহ ভালো আব্বু।এই এটুকু হয়েছে(হাত দিয়ে ইশারা করে) আশমিন জায়িন চৌধুরীর মেয়েরা কিনা ইদুরের বাচ্চার সাইজ নিয়ে দুনিয়ায় এলো! ওদের কান্না ও ঠিক ভাবে শুনতে পাচ্ছিলাম না।চোখ খুলে আমাকে দেখেনি ওরা।আমার নূরের কতো কষ্ট হয়েছে! সব কয়টা কে কুকুর দিয়ে খাওয়াবো আমি।কার কলিজায় হাত দিয়েছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাবে।(দাতে দাত চেপে)
নূরের জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই নূর অস্থির হয়ে আছে বাচ্চাদের জন্য। আশমিন বুঝিয়ে ও রাখতে পারছে না। অপারেশনের পর নূরের বেশি নড়াচড়া করা নিষেধ। সে মেয়ে এখন চিংড়ি মাছের মতো তিরিং বিরিং করছে।প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো আশমিনের।জোড়ে ধমক দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। মুখে হালকা হাসি টেনে দাতে দাত চেপে বললো,
— চুপচাপ শুয়ে থাকো বউ।আমার মেজাজ খারাপ হলে খুব খারাপ হবে।মেয়েদের জন্য এতো উতলা হয়ো না।বছর বছর এই অনুভূতি পাওয়ার সুযোগ পাবে তো তুমি।তোমার বরের মন অনেক বড়। সে তোমাকে টুইনস বেবির মা বানাবে।এবার চুপ করে ঘুমাও সোনা।একটু সুস্থ হলে পরিদের কাছে নিয়ে যাবো। এখন আমাকে একটা চুমু খাও।আমি চুমু শূন্যতায় ভুগছি।
নূর ব্যথা অস্থিরতা বাদ দিয়ে আশমিনের দিকে কটমট করে তাকালো। কোমরের নিচের অংশ এখনো অবস হয়ে আছে। সুস্থ হলে সবার আগে এই লোক কে পিটিয়ে হাতের সুখ করে নিবে।অসহ্য মানুষ একটা।
নূরের খেয়ে ফেলা লুক দেখে আশমিন এদিক ওদিক তাকিতুকি করলো।গলা ঝেড়ে দুঃখী গলায় বলল,
— এভাবে তাকাচ্ছো কেন? আমি কতো টেনশনে ছিলাম জানো? এই বারান্দায় কতো বার চক্কর লাগিয়েছি ধারণা আছে? তোমার জন্য আমার ব্যক্তিগত বুকে পোষা মীরজাফর কলিজা লাফিয়ে বাইরে চলে আসছিল প্রায়!কতো কষ্টে চেপে চুপে আটকে রেখেছি হিসেব আছে! আর এখন তুমি আমাকে চোখ দেখাচ্ছো! মানবতা আজ কোথায়? আজকেই মানবাধিকার কমিশনে একটা লিখিত অভিযোগ জানাতে হবে। আমি গাল এগিয়ে দিচ্ছি চুপচাপ চুমু খাও।নাহলে আমি জোর করে ও নিতে পারি।
নূর চোখ বুজে রইলো। কথা বলার ইচ্ছা আগ্রহ কোনটাই নেই।এই লোকের রেললাইনের মতো মুখ লাগাম ছাড়া চলতেই থাকে।
নূর কে চোখ বন্ধ করতে দেখে বিজয়ের হাসি হাসলো আশমিন। যাক, আপাতত শান্ত করা গেছে।এটা কে বলে প্রতিভা। বউ কে চুপ করানো তার কাছ থেকে শিখা উচিত। সময় থাকলে একটা কোচিং সেন্টার খোলা যেতো। আহা!কতো অসহায় স্বামীদের উপকার হতো। এটা ও একপ্রকার জনসেবা।
সানভি আশমিন কে ম্যাসেজ করলো বাইরে আসার জন্য। আশমিন আজ দুই দিন কিছুই মুখে দেয়নি।তার উপর তার বুকের ব্যথা ক্রমশ বাড়ছে। ডাক্তার কয়েকটা টেস্ট দিয়েছে।কিন্তু আশমিন নূরের কেবিনে ঘাপটি মেরে বসে আছে। অমি কাল সারাক্ষণ এখানে ছিল।সকালে লুবানা কে নিয়ে বাসায় গিয়েছে। একেবারে অফিস করে বিকেলে আসবে।আগামী কয়েকদিনের দলীয় সমস্ত মিটিং ক্যানসেল করেছে আশমিন।অফিস আমজাদ চৌধুরী সামলে নিবেন।
সানভির মেসেজ পেয়ে বেরিয়ে এলো আশমিন। চোখে মুখে ক্লান্তি চেপে ধরেছে।সানভি নিজেও ক্লান্ত।
— আপনার পোশাক নিয়ে এসেছি স্যার।ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নিন। খাবার রেডি আছে।একবার টেস্ট করিয়ে নিতে হবে।আর না করবেন না স্যার প্লিজ।
সানভির করুন গলা শুনে মলিন হাসলো আশমিন। উদাশ চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে মলিন গলায় বলল,
— মানুষ চোখের ভালবাসা কেন অনুভব করে না সান?চোখ তো মনের আয়না। ভালবাসার মানুষ টা আমার চোখে থাকা ভালবাসা, অভিমান, কষ্ট অনুভব করতে পারে না এই পরাজয় আমি কিভাবে মেনে নেই সান? সে আমাকে কষ্ট দেক।আঘাত করুক।আমি মেনে নিবো।কিন্তু সে আমার চোখের ভাষা বোঝে না এটা আমি কিভাবে সহ্য করি বলো তো? আমার মনে রাজ করা মানুষ টার ভালবাসায় এতো ক্ষাদ আমার সহ্য হচ্ছে না। ছোট বেলা থেকেই আমি শুধু অবহেলা পেয়ে গেলাম বুঝলে? আপনজনদের অবহেলা নিতে নিতে আমি ক্লান্ত।তুমি কোন ব্যথা সারাবে সান? এই বুকে সারাক্ষণ আমার প্রিয় মানুষ গুলো আঘাত করে চলেছে। ক্ষত সারাতে মলম দিতে হয়।পুনোরায় একই জায়গায় আঘাত করলে কি ক্ষত সারবে? এসব বাদ দাও। বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও। প্রয়োজন হলে আমি ডেকে নিবো।
আশমিন আবার নূরের কেবিনে চলে গেলো। সানভি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আশমিনের কষ্ট সে বোঝে।এতো বছর ছায়ার মতো লেগে আছে তার পিছনে। আশমিনের প্রতিটি নির্ঘুম রাতের সাক্ষী সে।কি গভীর যন্ত্রণায় মাঝ রাতে বারান্দায় ডুকরে কেদে উঠতো আশমিন। এমন শক্ত পোক্ত গম্ভীর মানুষ টা কে রাতের আধারে কাদতে দেখে নিজের চোখ ও ভিজে উঠতো সানভির।নূরের প্রতিটি কথা আশমিন কে গভীর ভাবে আঘাত করে। আশমিন হাসি মুখে এড়িয়ে যাওয়ার ভান করলেও সানভি বোঝে তার স্যার হাসি মুখে আঘাতের বি*ষ পান করছে। মাঝে মাঝে সানভির খুব আফসোস হয় নূরের জন্য। এমন একটা ভালবাসার মানুষ পেয়ে ও সে অবহেলা করছে।যদি কখনো হারিয়ে যায় কেদেও কুল পাবে না।
পনের দিন পরে আজ নিজের মেয়েদের কাছে পেয়েছে নূর।সে নিজেও পুরো পুরি সুস্থ না।তাই এখনো হসপিটালে আছে।আমজাদ চৌধুরী প্রতিদিন এসে নাতনিদের দেখে যান।কামিনী চৌধুরী একবার ও আসেনি।মায়া বেগম কয়েকবার এসেছে।আশমিন কড়া গলায় তাকে বাসায় থাকতে বলেছে।তার একমাত্র কাজ হচ্ছে কামিনী চৌধুরীর উপর নজর রাখা। আর কোন ছাড় দেয়া হবে না কামিনী চৌধুরী কে।
বাচ্চাদের নিজের কোলে নিয়ে কেদে ফেললো নূর।আশমিন চোখ ভরে দেখছে তার রাজকুমারীদের। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখের মুহুর্ত বুঝি এটাই।একজন নার্স এসে নূর কে ফিডিং করাতে বললে নূর উসখুস করতে লাগলো। আড় চোখে আশমিনের কয়েকবার তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিচ্ছে।আশমিন তীক্ষ্ণ চোখে নূরের দিকে তাকিয়ে আছে। নার্স আবার তারা দিতেই নূর আমতা আমতা করে বললো,
— ওনাকে বাইরে যেতে বলুন।
আশমিন যেন এই কথার অপেক্ষায় ই ছিল।সাথে সাথে গম্ভীর গলায় নার্স কে উদ্দেশ্য করে বললো,
— আউট।
নার্স কোন দিরুক্তি না করেই বেরিয়ে গেল। নূর হতভম্ব গলায় বলল,
— আরে আমি আপনাকে বলেছি।
— আমি থাকতে তাকে কেন লাগবে? আমি হেল্প করছি। আমাদের মধ্যে প্রাইভেসি বলতে কিছু নেই।এই মুহুর্ত গুলো খুব অমূল্য নূর। তোমার এই সুখের কষ্টে আমি তোমার সহযোদ্ধা।তোমার জন্য আমি ই যথেষ্ট।
কথা বলতে বলতেই নূর কে হেল্প করে মাথার পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো আশমিন।
— বসতে কষ্ট হচ্ছে?
নূর মাথা নাড়িয়ে না বললো। আশমিনের চোখের দিকে তাকালে তার বিশ্বাস হয়না সে তার বাবাকে খু*ন করেছে।তবে আশমিনের খাপছাড়া ভাব আর স্বিকারউক্তি তার ভাবনা গুলুকে বারবার এলোমেলো করে দেয়। এই দোটানায় সে নিজেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। আশমিন যদি সত্যি তার বাবাকে খু*ন করে থাকে তাহলে তাকে মরণ যন্ত্রণা দিবে সে। একবার সঠিক তথ্য তার হাতে আসুক। একটা ডায়েরির উপর ভিত্তি করে কোন পদক্ষেপ নেয়া উচিত হবে না। আর রইলো আশমিনের স্বিকার উক্তি,আশমিনের মতো বদ লোকের কোন কথা ধরা মানে নিজের মাথা দেয়ালে মারা।আস্তো ইতর একটা।
— আমার ডাক্তার হওয়া উচিত ছিল বউ।ওই ডাক্তার আমার বউয়ের পেট কেটে দুই ভাগ করে ফেললো আর আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম! ডাক্তার হলে কি এই দিন দেখতে হতো বলো? বউ ও আমার বউয়ের পেট ও আমার।আর কাটলো কি না ডাক্তার! শুধু আমার রাজকন্যা গুলোর জন্য কিছু বললাম না। নাহলে আমিও ওই ডাক্তারের পেট কেটে দিতাম। মিনিস্টার আশমিন জায়িন চৌধুরীর বউয়ের পেট কেটে ফেলে! কি সাহস ভাবা যায়?
আমার জীবন বিডিতে নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন, প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url