ফজরের নামাজ কয় রাকাত - নামাজের ওয়াক্ত ও রাকাতসমূহের সহীহ বিবরণ ২০২৪

আমরা এই পোস্টের মাধ্যমে আপনাদের সামনে তুলে ধরবো ফজরের নামাজ কয় রাকাত থেকে শুরু করে এশার নামাজ কয় রাকাত। আরো জানবো সকল নামাজের ওয়াক্ত ও রাকাতসমূহের সহীহ বিবরণ। 

ইতিহাস
ইসলামের বিভিন্ন বর্ননা অনুযায়ী মুহাম্মাদ (সাঃ) ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেন এবং অব্যবহিত পরে সূরা মু'মিন-এর ৫৫ নম্বর আয়াত স্রষ্টার পক্ষ থেকে সকাল ও সন্ধ্যায় দৈনিক দুই ওয়াক্ত নামাজ মুসলমানদের জন্য ফরজ (আবশ্যিক) হওয়ার নির্দেশনা লাভ করেন। তিনি ৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে সকাল, সন্ধ্যা ও দুপুরে দৈনিক তিন ওয়াক্ত নামাজের আদেশ লাভ করেন। ৬১৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে রজব তারিখে মিরাজের সময় পাঁচওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। রসূলূল্লাহ (সাঃ) বলেন, আল্লাহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন। (আবু দাউদ, আহমদ, মালেক, নাসায়ি, মেশকাত) উল্লেখ্য যে, এ সময় জোহর, আসর ও এশা ২ রাকায়াত পড়ার বিধান ছিল। ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে আল্লাহর তরফ থেকে ২ রাকায়াত বিশিষ্ট জোহর, আসর ও এশাকে ৪ রাকায়াতে উন্নীত করার আদেশ দেয়া হয়।
ফজরের নামাজ কয় রাকাত - নামাজের ওয়াক্ত ও রাকাতসমূহের সহীহ বিবরণ ২০২৪

আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের ওপর দিন-রাত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন। কুরআন মাজীদে কতিপয় আয়াতে নামাযের ৫টি ওয়াক্তের প্রতি ইঙ্গিত
করা হয়েছে; যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,

'আর নামায কায়েম কর দিনের দু' প্রান্তভাগে (অর্থাৎ ফজর ও মাগরেবের সময়) ও রাতের প্রথমাংশে (অর্থাৎ এশার সময়)। (সূরা হুদ, আয়াতঃ ১১৪)

সূর্য ঢলে যাওয়ার পর হতে রাতের ঘন অন্ধকার পর্যন্ত (অর্থাৎ যোহর, আসর, মাগরেব ও এশার) নামায কায়েম কর, আর কায়েম কর ফজরের নামায। (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াতঃ ৭৮)

আর সূর্যোদয়ের পূর্বে (ফজরে) ও সূর্যাস্তের পূর্বে (আসরে) তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর এবং পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর রাত্রির কিছু সময়ে (এশায়) এবং দিনের প্রান্তভাগগুলিতে (ফজর, যোহর ও মাগরেবে), যাতে তুমি সন্তুষ্ট হতে পার। (সূরা ত্বোয়া-হা, আয়াতঃ ১৩০)


সূচিপত্র

ফজরের নামাজ কয় রাকাত 

ফজরঃ পাখি ডাকা ভোরে কিছুটা আঁধার থাকতেই অর্থাৎ সকালের আভা ছড়িয়ে পড়ার আগেই এই নামাজ আদায় করে নেয়া ভাল। তবে ক্ষেত্র বিশেষে প্রয়োজনে সূর্যের উদীয়মান প্রথম অংশ পূর্ব দিগন্তরেখা
অতিক্রম করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত নামাজ আদায় করে নেয়া যেতে পারে। সূর্যোদয়ের সময় নামাজ পড়া নিষেধ। আনাস (রাঃ) বলেন,

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) 'গালাসে' (অর্থাৎ একটু অন্ধকার থাকতে) ফজরের নামাজ পড়তেন। (বুখারি ও মুসলিম)

আয়েশা (রাঃ) বলেন, রসূলুল্লাহ (সাঃ) ফজরের নামাজ এমন (অন্ধকার) সময়ে পড়তেন যে, নামাজী মেয়েরা চাদর জড়িয়ে ফেরার সময় অন্ধকারের কারণে তাদেরকে চেনা যেত না। (বুখারি, মেশকাত)

আকাশবিদ পন্ডিতদের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, সূর্য ডোবা থেকে সূর্য ওঠা পর্যন্ত সময়টাকে আট ভাগে ভাগ করলে ৭ ভাগের শেষ ও ৮ ভাগের শুরুটা ফজরের আওয়াল ওয়াক্ত। এরূপ চান্দ্র মাসের ১৩ তারিখে চাঁদ ডোবার ও ২৬ তারিখে চাঁদ ওঠার সময়টাও ফজরের আওয়াল ওয়াক্ত বলে প্রমাণিত হয়। অভিজ্ঞতায় এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, সাধারণতঃ সূর্য ওঠার দেড় ঘন্টা আগে এবং মৌসুম অনুযায়ী কখনো তারও ১৫-২০ মিনিট আগে-পরে সুবহে সাদিক উদিত হয়, যাকে ফজরের আওয়াল ওয়াক্ত বলে। ইমাম তাহাভি (রহঃ) বলেন, রসূলূল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে বর্ণিত হাদিস মোতাবেক গালাসে ফজরের নামাজ শুরু করা উচিত এবং এসফারে (একটু ফর্সা হলে) শেষ করা উচিত। এটাই হল ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আবু ইউসুফ ও মোহাম্মদ রহেমাহুমুল্লাহ প্রমুখের মত এমনটাই। (শারহে মাআ-নীল আসা-র ১ম খন্ড, ৯০ পৃ)

রাকাত সংখ্যাঃ ফজরের নামাজ মোট চার রাকাত। প্রথমে দুই রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা (আবশ্যক) এবং অতঃপর দুই রাকাত ফরজ।

যোহরের নামাজ কয় রাকাত

যোহরঃ মধ্যাহ্নে সূর্য তার সর্বোচ্চ স্থান থেকে কিছুটা হেলে পড়ার পর পরই নামাজ আদায় করে নেয়া ভাল। তবে সূর্যকিরণ যখন বেশ উত্তপ্ত থাকে, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে একটু দেরিতে অর্থাৎ সূর্যের তেজ কিছুটা কমে এলে নামাজ আদায় করে নেয়ার অবকাশ রয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে আছরের সময় হওয়া পর্যন্ত নামাজ আদায় করে নেয়া যেতে পারে। (মুসলিম) আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) গরমকালে ঠান্ডা হয়ে দেরী করে জোহর পড়তেন এবং শীতকালে জলদি পড়তেন। (নাসায়ি, মেশকাত)

রাকাত সংখ্যাঃ যোহরের নামাজ মোট বারো রাকাত। প্রথমে চার রাকাত সুন্নত (আবশ্যক), তারপর চার রাকাত ফরজ, তারপর দুই রাকাত সুন্নত (আবশ্যক) এবং সব শেষে দই রাকাত নফল। যদি কোন কারণে
ফরজের পূর্বে চার রাকাত সুন্নত আদায় করতে না পারে, তাহলে ফরজের পরে আদায় করে নিবে।

আসরের নামাজ কয় রাকাত

আসরঃ কোন জিনিসের ছায়া সমপরিমাণ হয়ে যাবার পর দ্বিগুণ হতে শুরু করা থেকে সূর্য ডোবা পর্যন্ত আসরের সময়। (মুসলিম) রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন,

সূর্য যখন হলদে রং হয় এবং শয়তানের দুই শিংয়ের মাঝখানে এসে যায় তখন মোনাফেকরা আসরের নামাজ পড়ে। (মুসলিম, মেশকাত)

সুতরাং সূর্যের আভা একটু হলদে রং হয়ে আসবার পূর্বেই আসর পড়া উচিত।ইমাম আবু হানীফা থেকেও বর্ণিত আছে যে, আসরের ওয়াক্তের শুরু হল এক ছায়া হতে। ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মোহাম্মাদ এবং ইমাম যোফার ও অন্য তিনজন ইমামের মতও তাই। মোহাদ্দেস ইমাম তাহাভী বলেন, আমরা এটাকে গ্রহণ করি। (তাহাভী ৭৮ পৃ)

গোরারুল আযকারে এটাই গৃহীত হয়েছে। জিবরাইলের বর্ণনা থেকে এটাই সুস্পষ্ট যে, এ ব্যাপারে এটাই হল সঠিক 'নাস্' ও হাদিস। (দূররে মোখতার ১ম খন্ড, ৫৯ পৃঃ)

রসূলূল্লাহ (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি আসরের নামাজ ছেড়ে দেয় তার আমল নষ্ট হয়ে যায়। (বুখারি, মেশকাত)

রাকাত সংখ্যাঃ আসরের নামাজ মোট আট রাকাত। প্রথমে চার রাকাত সুন্নতে জা'য়েদা (অনাবশ্যক) এবং অতঃপর চার রাকাত ফরজ।

মাগরিবের নামাজ কয় রাকাত 

মাগরিবঃ সূর্য সম্পূর্ণরূপে অস্ত যাবার পর কিছু সময়ের মধ্যেই নামাজ আদায় করে নেয়া ভাল। তবে সূর্যাস্তের পর হতে যতক্ষণ পর্যন্ত নিক্ষিপ্ত কোন তীরের পতিত হবার স্থান দৃষ্টিগোচর হয় অর্থাৎ গোঁধুলির রেশ বিরাজমান থাকা (পশ্চিম দিগন্তের লাল আভা অদৃশ্য হয়ে রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে না আসা) পর্যন্ত নামাজ আদায় করে নেয়া যেতে পারে। (মুসলিম, মেশকাত)

রাফে ইবনে খুদাইজ বলেন, আমরা রসূলূল্লাহ (সাঃ) এর সাথে নামাজ পড়তাম। তারপর আমাদের কেউ গিয়ে তীর ছুঁড়লে আমরা তার সেই তীর পড়ার জায়গাটা দেখতে পেতাম। (বুখারি, মুসলিম, মেশকাত)

রাকাত সংখ্যাঃ মাগরিবের নামাজ মোট সাত রাকাত। প্রথমে তিন রাকাত ফরজ, তারপর দুই রাকাত সুন্নত (আবশ্যক) এবং অতঃপর দুই রাকাত নফল।

এশার নামাজ কয় রাকাত

এশাঃ গোধুলী পেরিয়ে রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসার পর হতে এই নামাজের ওয়াক্ত শুরু হয় এবং রাতের এক তৃতীয়াংশ সময় থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত যে কোন সময়ে নামাজ আদায় করে নেয়া যেতে পারে। (মুসলিম, মেশকাত)

তবে জরুরী কারণ বশতঃ ফাজরের পূর্ব পর্যন্ত 'ইশার সালাত আদায় করা জায়িয আছে। (সহীহ মুসলিম, আবু কাতাদাহ থেকে- ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৭৯)

নু'মান বিন বাশীর (রাঃ) এর বর্ণনা অনুযায়ী (চাঁদের মাসের) তৃতীয় রাতে চাঁদ ডুবে গেলে এশার সময় হয়। (আবু দাউদ, হাঃ ৪১৯)

সূর্য ডোবার পর থেকে ঘড়ি ধরে দেড় ঘন্টা অতিবাহিত হলে এই ওয়াক্ত আসে।

রাকাত সংখ্যাঃ ইশার নামাজ মোট সতেরো রাকাত। প্রথমে চার রাকাত সুন্নতে জা'য়েদা (অনাবশ্যক), চার রাকাত ফরজ, তারপর দুই রাকাত সুন্নত (আবশ্যক), তারপর দুই রাকাত নফল এবং সবশেষে তিন রাকাত বিতরের ওয়াজিব নামাজ (আবশ্যক) ও পরে দুই রাকাত নফল। বিতরের নামাজ ইশার দুই রাকাত সুন্নত বা নফল নামাজের পরেই আদায় করে নেওয়া যায়।

ফজর, যোহর, আছর ও মাগরিবের নামাজ বেশি দেরি না করে ওয়াক্ত হয়ে যাবার কিছু সময়ের মধ্যেই আদায় করে নেয়া উত্তম। কোন কারনে সময় সম্পর্কে বেখেয়াল হয়ে গেলে বা ঘুমিয়ে থাকলে বা কোন বিশেষ কারনে কোন নির্দিষ্ট নামাজের ওয়াক্ত/সময় পেরিয়ে গেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা আদায় করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই নামাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে অর্থাৎ যে ওয়াক্তের নামাজ ছুটে গিয়েছে তা আগে আদায় করে নিতে হবে। যেমন সূর্যাস্তের আগে আছরের নামাজ আদায় করা সম্ভব না হলে সূর্যাস্তের পর আগে আছরের নামাজ এবং তারপর মাগরিবের নামাজ আদায় করতে হবে। তবে এরজন্য মহান আল্লাহতায়ালার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। সফরে থাকলে মাগরিব একটু দেরিতে পড়ে তার পরপরই ইশার নামাজ আদায় করে নেয়ার অবকাশ রয়েছে। আবার সূর্য ঢলে পড়ার আগে সফরে বের হলে যোহর একটু দেরিতে পড়ে একসাথে আছরের নামাজ আদায় করে নেয়া যায়।


জুমআর নামাজ কয় রাকাত 

জুম'আঃ অধিকাংশ আলেমের মতে, জুম'আ ও যোহরের সময় একই। যখন যোহরের শুরু হয় জুম'আও তখনই শুরু হয়। অর্থাৎ ঠিক দুপুরে সূর্য মাথার উপর থেকে পশ্চিমে কিছুটা ঢলে পড়লে জুম'আর সময় শুরু হয়। (বুখারী, হাঃ ৪১৬৮)

রাকাত সংখ্যাঃ জুম'আর নামাজে দুই রাকা'ত ফরজ, যা ইমামের সাথে আদায় করতে হয়। অধিকাংশ আলেমদের মতে, জুম'আর ফরজের পূর্বে চার রাকা'ত কাবলাল জুম'আ এবং ফরজের পরে চার রাকা'ত বা'দাল জুম'আর সুন্নত নামাজ আদায় করতে হয়। এছাড়া মসজিদে প্রবেশ করে দুই রাকা'ত দুখলুল মসজিদ ও দুই রাকা'ত তাহিয়াতুল ওযুর মোস্তাহাব নামাজ এবং চার রাকা'ত বা'দাল জুম'আর সুন্নত নামাজের পরে দুই রাকাত সুন্নাতুল ওয়াক্তিয়া নামাজও উৎসাহিত করা হয়। অর্থাৎ জুম'আর নামাজের বিবরণীতে বলা যায়ঃ

● মসজিদে প্রবেশ করে দুই রাকাত তাহিয়াতুল ওযু ও দুই রাকা'ত দুখলুল মসজিদের মোস্তাহাব নামাজ আদায় করবে (ঐচ্ছিক)
● চার রাকা'ত কাবলাল জুম'আর সুন্নত নামাজ একাকী আদায় করবে।
● ইমামের খুৎবা পাঠ মনোযোগ দিয়ে শুনবে।
● ইমামের সাথে দুই রাকা'ত জুম'আর ফরজ নামাজ আদায় করবে।
● ফরজ নামাজের পর তাৎক্ষণিকভাবে মসজিদ ত্যাগ করবে না, বরং চার রাকাত বা'দাল জুম'আর সুন্নত নামাজ এবং পরে দুই রাকাত সুন্নাতুল ওয়াক্তিয়া নামাজ একাকী আদায় করবে।

শেষ কথা ➡️ এই পোস্টে থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, ফজরের নামাজ কয় রাকাত থেকে শুরু করে এশার নামাজ কয় রাকাত কিভাবে আপনি এই সব নামাজ আদায় করবেন এক কথায় নামাজের ওয়াক্ত ও রাকাতসমূহের সহীহ বিবরণ তুলে ধরেছি আপনাদের সামনে। আপনার মতামত এবং প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত মূল্যবান এবং আমরা সব সময় তাদের স্বাগত জানাই। এই রকম আরো পোস্ট চাইলে কমেন্ট করে আমাদের জানান। আবার আপনার সাথে দেখা হবে পরবর্তী পোস্টে। ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আমার জীবন বিডিতে নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন, প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url